ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বিস্তৃত হলেও বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ও উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর একটি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও যুদ্ধ পরিস্থিতি। ফিলিস্তিন, লেবানন, ইয়েমেন এবং সিরিয়ায় একের পর এক হামলা এবং ইরানের সঙ্গে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের সম্ভাবনা সামনে এনে পুরো অঞ্চলজুড়ে এক অশান্ত ভবিষ্যতের আভাস দিচ্ছে ইসরায়েল। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটভূমিতে নতুন ধারা যুক্ত হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সামরিক তৎপরতা, ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে ইরানের মিত্রদের জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা এবং একটি ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। এ পরিস্থিতিতে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ, ফিলিস্তিনে দীর্ঘদিন ধরে চলা দমন-পীড়ন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা, এবং জাতিসংঘসহ বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। এসব বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী। তিনি সংবাদমাধ্যমে শিক্ষা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে বিশ্লেষণ ও মতামত দিয়ে থাকেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের ঢাবি প্রতিনিধি ফাইয়াজ উদ্দিন স্মরণ।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: ফিলিস্তিন, লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় হামলার মাধ্যমে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল যেভাবে যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে সেটাকে আপনি কীভাবে দেখেন? বিশেষ করে ইরানের সাথে যুদ্ধ শুরুর বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: সৌদি আরবসহ ২১টি মুসলিম দেশ ইরানে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানালেও এই তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকা ভবিষ্যতে ঐতিহাসিক ভুল হিসেবেই চিহ্নিত হবে। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আগ্রাসন কৌশল মূলত একটি বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির অংশ, যার উদ্দেশ্য হলো ইরানের প্রভাব খর্ব করা এবং প্রতিপক্ষদের একযোগে দুর্বল করে তোলা। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি এবং সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের উপর ধারাবাহিক হামলা মূলত একটি ‘Preemptive Containment Doctrine’ অনুসরণ করছে। ইরানের সঙ্গে এ যুদ্ধ চলতে থাকলে একসময় তা শুধু ইসরায়েল-ইরানে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্য একটি বহুমাত্রিক সংঘর্ষে ঢুকে পড়বে। এটি পারস্য উপসাগরের নিরাপত্তা, তেল সরবরাহ এবং বিশ্ব অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলবে। সবসময় রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধের বিপক্ষে থাকা উচিত, কারণ এই সংঘর্ষ অঞ্চলজুড়ে মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার দৃষ্টিতে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের মূল কারণ কী? এটি কেবল ধর্মীয়, নাকি এর পেছনে ভূ-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বা অন্যান্য স্বার্থও রয়েছে?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং এটি একটি জটিল বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব, যার পেছনে ভূ-রাজনৈতিক, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত। প্রথমত, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইরান একটি শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে ফিলিস্তিনের অধিকারকে সমর্থন করে। অন্যদিকে, ইসরায়েল একটি ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। তবে এই ধর্মীয় বিভাজন রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের আড়ালে ঢেকে থাকে।
দ্বিতীয়ত, ভূ-রাজনৈতিকভাবে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের (বিশেষত ন্যাটো এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। ইরান সিরিয়া, লেবানন (হিজবুল্লাহ), ইয়েমেন (হুথি), ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের মাধ্যমে একটি ‘শিয়া ক্রিসেন্ট’ প্রতিষ্ঠা করেছে, যা ইসরায়েলের জন্য পারসিভড নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে। ফলে ইসরায়েল ইরানি প্রভাব হ্রাসে নিয়মিত সিরিয়া ও গাজায় হামলা চালিয়ে থাকে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রমাণ করে।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক স্বার্থও এই সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে। ইরান ‘পারমাণবিক কর্মসূচি’ চালিয়ে যাচ্ছে, যা ইসরায়েলের কাছে একটি কৌশলগত হুমকি। ইসরায়েল মনে করে, পারমাণবিক শক্তিধর ইরান মধ্যপ্রাচ্যে শক্তির ভারসাম্যকে পরিবর্তন করে ফেলবে। অন্যদিকে, ইরানের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে আছে তেল রপ্তানি, হরমুজ প্রণালি নিয়ন্ত্রণ এবং নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলার সঙ্গে। ইসরায়েল এবং তার মিত্ররা এই অর্থনৈতিক সক্ষমতাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: ইসরায়েলের এই সামরিক দাম্ভিকতা ও মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী বলে মনে করেন?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলের কৌশলগত পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করে আসছে। সামরিক সহায়তা, কূটনৈতিক ঢাল এবং জাতিসংঘে একাধিক ভেটো ব্যবহার করে তারা ইসরায়েলের আগ্রাসনকে কার্যত উৎসাহ দিয়ে আসছে। এই সহযোগিতা ইসরায়েলকে জবাবদিহিতার বাইরে নিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই একটি ন্যায্য শান্তি চায়, তবে তাকে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র শক্তির ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি জড়ানোর ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাজ্যও সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, ইরানের মিত্ররাও যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন, এ প্রেক্ষিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে কী?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা এখনো তুলনামূলকভাবে কম। এমন যুদ্ধ হলে তা সম্ভবত পারমাণবিক যুদ্ধেই রূপ নেবে, যেখানে Mutually Assured Destruction (MAD) তত্ত্ব অনুযায়ী সব পক্ষই বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা কিংবা চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও এই সত্যকে প্রমাণ করে যে, বড় পরিসরের যুদ্ধ হলেও তা বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয় না। তবে, ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের আন্তর্জাতিকীকরণের কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি হামলা, তেলআবিবে ইরান-মিত্রদের পাল্টা প্রতিক্রিয়া, জি৭ সম্মেলন থেকে ইরানকে হুঁশিয়ারি এবং সৌদি আরবসহ ২১টি মুসলিম দেশের ইসরায়েলি হামলার নিন্দা—সবই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মাত্রা দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহ্যগতভাবে ইসরায়েলের কৌশলগত মিত্র হিসেবে ইতোমধ্যে আকাশ প্রতিরক্ষা ও সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। একইভাবে যুক্তরাজ্যও মধ্যপ্রাচ্যে নৌবাহিনী মোতায়েন করে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট। অপরদিকে, ইরানের মিত্র হিসেবে হিজবুল্লাহ (লেবানন), হুথি (ইয়েমেন) ও ইরাক-সিরিয়ার শিয়া মিলিশিয়ারা সংঘাতে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সংঘাত আঞ্চলিকভাবে বিস্তৃত হলেও তা বৃহত্তর আন্তর্জাতিক যুদ্ধে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। এর পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে— পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন) সরাসরি সংঘাতে যেতে চায় না, কারণ তা বৈশ্বিক ধ্বংস ডেকে আনবে; বিশ্বব্যবস্থা এখন গভীরভাবে আন্তঃনির্ভরশীল, যেখানে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ অর্থনৈতিকভাবে কারো পক্ষে লাভজনক নয়; এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চ্যানেলগুলো উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
তবু সংঘাতটি আঞ্চলিকভাবে ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। বিশেষত যদি হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল সীমান্তে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হয়, কিংবা হরমুজ প্রণালীতে তেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং অভিবাসন সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা আন্তর্জাতিক অস্থিরতা বাড়াবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, একে “তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ” বলা না গেলেও এটি একটি “সীমিত বহুপাক্ষিক সংঘাত” বা “হাইব্রিড ও প্রক্সি যুদ্ধ” হিসেবে বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য গভীর হুমকি তৈরি করছে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমানে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র কি পৃথিবীর জন্য নিরাপদ?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে তাদের নীতি ও আচরণের উপর। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যদি মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক আইন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করত, তাহলে তাদেরকে গ্লোবাল স্ট্যাবিলাইজিং ফোর্স হিসেবে বিবেচনা করা যেত।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই দুই রাষ্ট্র নির্বিচারে অস্ত্র ব্যবহার, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, এবং নির্বাচিত আক্রমণাত্মক কৌশল অনুসরণ করছে, যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি। ফলে বলা যায়, তাদের বর্তমান ভূমিকায় পৃথিবী নিরাপদ নয়, বরং আরও বিভক্ত ও সহিংস হয়ে উঠছে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের ভবিষ্যৎ কী বলে মনে করেন? কে জিতবে? কী হতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: এই যুদ্ধ যদি চলতে থাকে, তাহলে এটি হবে একটি অসমমৈত্রীক ও বহু-আঞ্চলিক সংঘর্ষ। সরাসরি যুদ্ধের ক্ষেত্রে ইসরায়েল প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকলেও, ইরান প্রক্সি যুদ্ধ ও অঞ্চলভিত্তিক প্রতিরোধে পারদর্শী। এ যুদ্ধে কেউই প্রকৃত অর্থে বিজয়ী হবে না। পরাজিত হবে মানবতা, অঞ্চলজুড়ে মরদেহ, শরণার্থী, অর্থনৈতিক ধ্বংস এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগই মূল চিত্র হবে। মধ্যপ্রাচ্য আরও অস্থিতিশীল, মেরুকৃত এবং অনিরাপদ হয়ে পড়বে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: ইরানের পরমাণু অস্ত্র অর্জন বিশ্ব রাজনীতিতে কতটুকু ব্যালেন্স বা সাম্যতা তৈরি করত? আমেরিকা-ইসরায়েল ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন ভালোভাবে নেয় না? আর এই মুহূর্তে ইরানের করণীয় কী?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: ইরান যদি পরমাণু অস্ত্র অর্জন করে, তাহলে সেটি মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি করতে পারত, বিশেষত ইসরায়েলের বিদ্যমান পারমাণবিক সক্ষমতার বিপরীতে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মনে করে, ইরানের পরমাণু সক্ষমতা তাদের আঞ্চলিক আধিপত্য ও নিরাপত্তা নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাবে। বর্তমানে ইরানের করণীয় হলো—কূটনৈতিক আলোচনার পথ খোলা রাখা, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করা। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকেও দ্বৈত নীতি ত্যাগ করে সব পক্ষের প্রতি সমান আচরণ করতে হবে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: প্রতিনিয়ত পৃথিবীতে এত বড় বড় সংঘাত হচ্ছে, জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো কেন থামাতে পারছে না?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: জাতিসংঘের কাঠামোতে পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা আন্তর্জাতিক বিচার ও হস্তক্ষেপকে প্রায়শই অকার্যকর করে দেয়। এছাড়া, জাতিসংঘের অনেক সংস্থা রাজনৈতিক চাপ, অর্থের অভাব ও সদস্য দেশগুলোর দ্বিচারিতার কারণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, যা বৈশ্বিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বড় বাধা।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: ফিলিস্তিনে যুগের পর যুগ ধরে ইসরায়েলের জাতিগত নিধন চলছে, তারপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নির্বিকার ভূমিকা মূলত ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের ফল। অনেক দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক বা সামরিক সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না। এছাড়া পশ্চিমা গণমাধ্যমের পক্ষপাতী ভূমিকা ও জাতিসংঘে ভেটো ব্যবহারের কারণে ইসরায়েলের প্রতি কার্যকর চাপ সৃষ্টি হয় না। এ অবস্থাকে নৈতিক ব্যর্থতা ও বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের পরাজয় হিসেবে দেখা যেতে পারে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল যা করছে, তাতে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ‘যুদ্ধ অপরাধ’ হচ্ছে কিনা?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: হ্যাঁ, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের কিছু কর্মকাণ্ড—যেমন বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্য করা, অবরোধ আরোপ, গণবিধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার, এবং অবৈধ বসতি স্থাপন—আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের পরিপন্থি। বিশেষজ্ঞরা একে ‘যুদ্ধাপরাধ ও জাতিগত নিধন’ -এর সামিল বলে আখ্যা দেন। তবে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতাধর দেশের সুরক্ষার কারণে।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: সংঘাত বন্ধে বিশ্ববাসী বা সংশ্লিষ্টদের করণীয় কী?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: বিশ্ববাসীর করণীয় হলো সামাজিক মাধ্যম ও শিক্ষার মাধ্যমে চেতনা বৃদ্ধি করা; সরকারগুলোকে ন্যায়সঙ্গগত অবস্থান নিতে বাধ্য করতে জনমত গঠন করা; জাতিসংঘ ও আঞ্চলিক সংস্থার ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা; সংঘাত কবলিত জনগণের জন্য আর্থিক ও মানবিক সহায়তা প্রদান করা। সর্বোপরি বিশ্বনেতাদের উচিত স্বার্থ নয়, ন্যায় ও মানবতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: যুদ্ধ ও সংঘাতমুক্ত পৃথিবী আদৌ সম্ভব কিনা?
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: সম্পূর্ণ যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী আদর্শিকভাবে সম্ভব, তবে বাস্তবতায় তা অত্যন্ত কঠিন। যুদ্ধ ও সহিংসতা ক্ষমতা, স্বার্থ, জাতিগঠনের ধারণা এবং অর্থনৈতিক অসমতার সঙ্গে জড়িত। তবে সহিংসতা হ্রাস, শান্তি শিক্ষা, সংঘাত প্রতিরোধ কাঠামো গঠন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা একটি তুলনামূলকভাবে নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।
উল্লেখ্য, ড. মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ২০১৪ সালে তিনি নরওয়ের বার্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে এমফিল করেন, যেখানে তিনি নরওয়েজিয়ান সরকারের একটি সম্মানজনক বৃত্তি লাভ করেন। পরবর্তীতে, ২০১৮ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি অধ্যয়নে পিএইচ.ডি প্রোগ্রামে ভর্তি হন এবং ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের আইপিআরএ বৃত্তির সহায়তায় ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তার গবেষণাকর্ম জাতিসংঘ-সম্পৃক্ত সংস্থা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রকাশনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। গবেষণার ক্ষেত্রে তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে হাইব্রিড পিসবিল্ডিং, সিকিউরিটোলজি, শরণার্থী অধ্যয়ন এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে গবেষণা ও নীতিগত পরামর্শমূলক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। পাশাপাশি, তিনি জনবুদ্ধিজীবীতার দায় থেকে গণমাধ্যমে সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়ে বিশ্লেষণ ও মতামত প্রদান করে থাকেন।