বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কেন রিজার্ভে হাজার–হাজার টন সোনা রাখে?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কেন রিজার্ভে হাজার–হাজার টন সোনা রাখে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কেন রিজার্ভে হাজার–হাজার টন সোনা রাখে  © সংগৃহীত

বিশ্বজুড়ে ডলার এবং অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার পাশাপাশি সোনাকেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসেবে ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রহ দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত। একসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ পুরোপুরি সোনার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং কোনো দেশের মুদ্রার মান নির্ধারিত হতো সেই দেশের সোনা ভান্ডারের ওপর ভিত্তি করে। পরে শিল্প উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের আধিপত্য শুরু হলে বিভিন্ন দেশ তাদের রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে বৈদেশিক মুদ্রা ও বন্ডে রূপান্তর করে। তবুও আজও বিশ্বের প্রায় সকল দেশের রিজার্ভের একটি অংশ সোনা আকারে রাখা হয়।

মার্কিন আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেপিমরগ্যান জানিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ডলার থেকে সোনায় স্থানান্তরের প্রবণতা বাড়ছে এবং এ কারণে বিশ্ববাজারে সোনার দাম ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২৪ সাল নাগাদ বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর কাছে মোট ৩৬,২০০ টন বা ৩ কোটি ৬২ লাখ কিলোগ্রাম সোনা রিজার্ভ ছিল, যা তাদের মোট সম্পদের ২০ শতাংশ। ২০২৩ সালে এ হার ছিল ১৫ শতাংশ।

চীন, তুরস্ক, ভারত, ইরাক ও আজারবাইজানসহ বেশ কয়েকটি দেশ ২০২৪ সালে এক বছরে অন্তত ২০ টন করে সোনা কিনেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ডলারের আন্তর্জাতিক দুর্বলতা, যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার কমে যাওয়া, অর্থনৈতিক এবং ভূ–রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা—এই কারণগুলো দেশ ও বিনিয়োগকারীদের সোনাকে নিরাপদ সম্পদ হিসেবে বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করছে। কারণ মুদ্রা বা বন্ডের মতো নয়, সোনার মূল্য কোনো একক নীতিগত সিদ্ধান্তে দ্রুত ধসে পড়ে না।

আরও পড়ুন: দেশে কত দামে স্বর্ণ ও রুপা বিক্রি হচ্ছে আজ?

জেপিমরগ্যানের পূর্বাভাস, যুক্তরাষ্ট্রের অস্থির বাণিজ্য নীতি ও অনিশ্চিত ভূ–রাজনৈতিক মিত্রতার কারণে ২০২৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আরও ৯০০ টন সোনা কিনতে পারে। সাধারণ ধারণা হলো, যে দেশের সোনার রিজার্ভ যত বেশি, তার মুদ্রা তত শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোনা রিজার্ভ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে—৮,১৩৩ টন (৮১ লাখ কিলোগ্রামের বেশি), যা তাদের মোট বৈদেশিক সম্পদের ৭৮ শতাংশ। আইএমএফের তথ্য বলে, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইতালির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মোট ১৬,৪০০ টন সোনা রয়েছে, এবং এই দেশগুলোর বৈদেশিক রিজার্ভের ৭০ শতাংশেরও বেশি সোনায় ধারণ করা।

চীন সোনা কেনায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী, চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে রয়েছে ২,২৯৮ টন সোনা, যা তাদের মোট বৈদেশিক সম্পদের ৬.৭ শতাংশ। ২০২৪ সালের শেষে চীনের সোনা রিজার্ভ ছিল ২,২৭৯ টন এবং ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে দেশটি আরও ১৯ টন সোনা কিনেছে; এই সময় যুক্তরাষ্ট্র কোনো সোনা কেনেনি। ২০২৩ সালে চীন ৮৮ টন সোনা কিনেছিল।

চীনের পাশাপাশি পোল্যান্ড ও তুরস্কও সক্রিয়ভাবে সোনা কিনছে।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১৪.৮ টন সোনা রয়েছে, যার আর্থিক মূল্য দেড়শো কোটি টাকার বেশি এবং এটি মোট রিজার্ভের ৫.৬৫ শতাংশ। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ৮৮০ টন সোনা রয়েছে, যার পরিমাণ ৯,৩০০ কোটি ডলার এবং এটি ভারতের বৈদেশিক রিজার্ভের ১৩ শতাংশ। পাকিস্তানের রিজার্ভে রয়েছে ৬.৪ টন, যার মূল্য ৭০০ কোটি ডলার।

চলতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে পরে কিছুটা কমেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভূ–রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আর্থিক অনিশ্চয়তা এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

পণ্য বিশেষজ্ঞ শামস–উল–ইসলাম জানান, যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্য যুদ্ধ সোনার দামের অন্যতম বৃদ্ধি–কারক। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি ঘোষণার পর চীন সোনা কিনে এবং দাম আউন্সপ্রতি ৪,৩৮০ ডলারে পৌঁছালে মুনাফায় বিক্রি করে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আহসান মেহান্তি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে ১ অক্টোবর শুরু হওয়া অর্থবছরের বাজেট অনুমোদিত না হওয়ায় সরকার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে এবং বিনিয়োগকারীরা মার্কিন বাজার থেকে সরে এসে সোনায় বিনিয়োগ করে, যা দাম বাড়ায়। একই সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এশিয়া সফর ও তার চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্ভাব্য বৈঠক পর্যবেক্ষণে রয়েছে বিশ্ববাজার, এবং বাণিজ্য উত্তেজনা কমার সম্ভাবনা থাকায় সাময়িকভাবে সোনার দাম কমেছে।

শামস–উল–ইসলাম আরও বলেন, চীন ও ব্রিকস দেশগুলো বৈশ্বিক বাণিজ্যে ডলারের প্রভাব কমাতে কৌশলগতভাবে সোনা ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও এশিয়ার অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং ভারতসহ অনেক দেশ সোনা কেনার মাধ্যমে নিজেদের মুদ্রাকে শক্তিশালী করছে।


সর্বশেষ সংবাদ