রেজাল্ট নিয়ে কখনোই আলোচনায় না থাকা নাফিসা পেলেন ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪১ PM , আপডেট: ৩১ আগস্ট ২০২৫, ০৭:৫০ AM
একটি সময় ছিল, যখন কোনো এলাকায় একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেতো তখন উৎসবে মাতত পুরো মহল্লা। তাকে একনজর দেখতে ভিড় জমাত প্রতিবেশীরা। সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের ক্যামেরা ঘুরত তার বাড়ির সামনে। কীভাবে সে পড়ল, কার কাছে পড়ল, কত ঘণ্টা পড়ল; এসব নিয়ে থাকত বিস্তর আলোচনা। সাক্ষাৎকারে উঠত অনুপ্রেরণার গল্প, অভিভাবকের ত্যাগ, শিক্ষকের গর্ব, প্রতিবেশীর উচ্ছ্বাস। জাতীয় পত্রিকায় বড় ছবি ছাপা হতো ‘অসাধারণ ফল’ করার স্বীকৃতি হিসেবে।
কিন্তু সময় বদলেছে। কালের বিবর্তনে সেই চিত্র আজ শুধুই স্মৃতি। এখন প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পায়। ফলাফল পাওয়ার দিনে পত্রিকায় একসঙ্গে ছাপা হয় কয়েক হাজার জিপিএ-৫ প্রাপ্তির খবর। এমনকি অনেকে আছে, যারা জিপিএ-৫ পেয়েও জানে না এর পূর্ণরূপ (Grade Point Average!) এটা নিছকই রসিকতা নয়, বাস্তবতার নির্মম চিত্র।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৫ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার ফলাফল। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারে জিপিএ-৫ এবং পাসের হার দুটোই কমেছে। ফলে ভর্তিচিন্তা, কলেজ পাওয়া যাবে কি না এসব প্রশ্নে মানসিক চাপ বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মাঝে। বিশেষ করে যারা ৪.৯৯ বা ৪.৫০ পেয়েছে, তারা ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছেন‘ এই ফলাফল দিয়ে কি হবে?’
আরও পড়ুন: এসএসসিতে ৩.৩৮ পেয়েছিলেন, আল-আমিন এখন বিসিএস ক্যাডার
তবে এখানে একটি কথা মনে রাখা জরুরি শুধু ফলাফলই জীবনের মানদণ্ড নয়। এসএসসিতে জিপিএ-৫ না পেয়েও বহু শিক্ষার্থী আজ নিজেদের সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছেন। কেউ বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন, কেউ বিদেশি স্কলারশিপে উচ্চশিক্ষায় গেছেন, কেউবা হয়েছেন উদ্যোক্তা।
তাদের একজন হচ্ছেন বাংলাদেশের তরুণী নাফিসা মোসাদ্দেক। তিনি ক্লাসে কম সিজিপিএ পেয়েও দক্ষিণ কোরিয়ায় মাস্টার্স করার জন্য ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ পেয়েছেন। নাফিসা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। উচ্চতম সিজিপিএ বা ব্যতিক্রমী একাডেমিক রেজাল্ট নিয়েও কখনো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছিলেন না কোনো আলোচিত।
জানা যায়, এ বছর দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের ‘গ্লোবাল কোরিয়া স্কলারশিপ’ (জেকেএস) প্রোগ্রামের আওতায় ‘ইউনিভার্সিটি ট্র্যাক–রিজিওনাল ক্যাটাগরি (R-GKS)’ তে নির্বাচিত হয়েছেন মাত্র ১৬ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। প্রতিযোগিতামূলক এই স্কলারশিপ প্রোগ্রামে স্থান পাওয়াটা সহজ ছিল না তার জন্য। কারণ এই স্কলারশিপে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের বড় অংশ ছিল উচ্চ সিজিপিএধারী, ইংরেজি ভাষায় আইইএলটিএস সম্পন্ন করা প্রার্থী এবং ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক নানা কনফারেন্স কিংবা পেশাগত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। তবু, সবার ভিড়ে নিজের একান্ত প্রস্তুতি, লক্ষ্যের প্রতি নিষ্ঠা আর কঠোর পরিশ্রম দিয়েই নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন এ শিক্ষার্থী।
আরও পড়ুন: ‘ফলাফল নয়, দক্ষতাই আসল—জিপিএ ৫ না পেলেও পাবেন স্কলারশিপ’
এছাড়াও এইচএসসি পর্যায়ে ইংরেজি বিষয়ে পাননি এ+। এমনকি আবেদনকালে আইইএলটিএস স্কোর জমা দেওয়ার সুযোগও হয়নি তার। তথাপি, দক্ষিণ কোরিয়ার স্কলারশিপ কমিটি তার আবেদন বিবেচনায় রেখেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি মানদণ্ডে: পার্সোনাল স্টেটমেন্ট এবং স্টাডি প্ল্যান।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে নাফিসা মোসাদ্দেক জানান, আমি জানতাম আমার একাডেমিক প্রোফাইল অন্যদের তুলনায় ব্যতিক্রম কিছু নয়। তাই আমি সব জোর দিয়েছি ওই দুটি লেখায়। প্রতিটি বাক্যে আমার জীবনের লক্ষ্য, নিজের অবস্থান, অভিজ্ঞতা, এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছি। আমার বিশ্বাস, এখানেই ছিল আমার শক্তি।
দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত জেকেএস স্কলারশিপটি পূর্ণ অর্থ সহায়তার সুযোগ দিয়ে বিশ্বজুড়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেয়। এই স্কলারশিপের আওতায় নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের শতভাগ টিউশন ফি ছাড়াও মাসিক ভাতা, আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়া, স্বাস্থ্যবিমা, থিসিস ও গবেষণা ব্যয় এবং এক বছরের কোরিয়ান ভাষা কোর্সের সুযোগ দেওয়া হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে মাস্টার্স করতে কয়েকদিনের মধ্যে তিনি দেশ ত্যাগ করবেন। তার মতে, ‘সিজিপিএ, পরিচিতি বা ভাষার স্কোরই শেষ কথা নয়। বরং সত্যিকারের উদ্দেশ্য, নিষ্ঠা এবং নীরব পরিশ্রমই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়।’