এক দেশে দুই শিক্ষানীতি: বৃত্তি পরীক্ষায় কেন বাদ পড়ছে কিন্ডারগার্টেন?

লেখক
লেখক  © সৌজন্যে প্রাপ্ত

শিশুদের জন্য শিক্ষা কোনো করুণা নয়, এটি একটি মৌলিক অধিকার। অথচ সেই অধিকারের পথে তৈরি হচ্ছে অদৃশ্য এক দেয়াল। আগামী ২১ থেকে ২৪ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন উপজেলায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রাথমিক স্তরের মেধাভিত্তিক বৃত্তি পরীক্ষা।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে কেবল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অথচ, দেশের হাজার হাজার সরকারি নিবন্ধিত কিন্ডারগার্টেন ও স্বীকৃত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই পরীক্ষার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।

এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ইতোমধ্যেই সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদী, যশোরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মানববন্ধন ও স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাদের দাবি স্পষ্ট—শিক্ষার অধিকার সবার জন্য সমান হওয়া উচিত, কোনো শিশুকে তার প্রতিষ্ঠানের নাম বা শ্রেণি দিয়ে বঞ্চিত করা যাবে না।

শিক্ষার সাম্যতা কেন হলো বিভাজিত?

গণমাধ্যমের বিভিন্ন সূত্র মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬১ হাজার কিন্ডারগার্টেন ও পাবলিক স্কুল রয়েছে, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ সরকারি নিবন্ধনভুক্ত। এসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে নিয়মিত কাজ করে আসছে।

তবুও, বৃত্তি পরীক্ষায় তাদের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া কেবল অন্যায় নয়, বরং দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্যের বড় দৃষ্টান্ত। শিক্ষার মূল্যায়ন কি সত্যিই শিক্ষার্থীর মেধার ভিত্তিতে হবে? নাকি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও শ্রেণি বিবেচিত হবে?

ভাঙচুর করা হচ্ছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীর আশা

কিন্ডারগার্টেনের লাখ লাখ শিশু বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় নিয়ে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের স্বপ্ন দেখেছে। ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা চালু থাকাকালে বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে পুনরায় বৃত্তি পরীক্ষা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা এবার বাস্তবায়নের মুখে দাঁড়িয়েছে।

অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল নিবন্ধনপ্রাপ্ত, সরকারি নির্দেশনা মেনে চলছে। তাদের শিক্ষার্থীরা একই জাতীয় পাঠ্যক্রমে প্রস্তুতি নিচ্ছে, একই বই পড়ে। কিন্তু হঠাৎ করেই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বাদ দেওয়া হয়। এটা শিক্ষার্থীদের নয়, তাদের মেধার প্রতি এক অন্যায়, আর তাদের অভিভাবকদের প্রতারণার অনুভূতি দেয়।

সরকারি দ্বৈতনীতি ও সমন্বয়হীনতার চিত্র

সরকার বিভিন্ন সময়ে বলেছে, তারা কিন্ডারগার্টেন বন্ধ করতে চায় না। কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করা হলে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ জন্মায়। নতুন করে উদ্বেগের কারণ হলো—নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ সমন্বয়হীনতা। সচিব ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু দেড় মাসের মধ্যেই তারা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই দ্বৈততার কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের আস্থায় ফাটল পড়ছে।

নিবন্ধনপ্রাপ্ত কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের সশ্রদ্ধ প্রশ্ন

একজন নিবন্ধিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আঞ্জুমানারা লতা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘নন-এমপিও ভুক্ত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারে, তাহলে কেন নিবন্ধনপ্রাপ্ত কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীরা বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে না?’ ২০২৩ সালে সরকার নতুন করে শত শত কিন্ডারগার্টেনকে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে। তাহলে, তাদেরকে প্রাথমিক শিক্ষার বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া কি ন্যায়সঙ্গত?

সংবিধানের আলোকে শিক্ষানীতির বাস্তবতা

১৯৭২ সালের সংবিধানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “শিক্ষা হবে সবার জন্য, সমান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।” বর্তমান সরকার নিজেকে বৈষম্যবিরোধী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। তবে চলতি বছরের বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার্থীদের বঞ্চনা এই সংবিধানিক প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে যায়। শিক্ষা যদি প্রকৃত অর্থে মৌলিক অধিকার হয়, তাহলে তার মূল্যায়নেও ন্যায়পরায়ণতা থাকা উচিত। একজন শিক্ষার্থীর মেধা, পরিশ্রম ও যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন হওয়া উচিত, স্কুলের নাম বা মালিকানার ভিত্তিতে নয়।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা:

সব শিশুই সমান সম্ভাবনার অধিকারী। রাষ্ট্রের কাজ সেই সম্ভাবনার সিঁড়ি তৈরি করা, ভেঙে দেওয়া নয়। সুতরাং সরকারের উচিত— চলতি বছরই কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া। পাশাপাশি আগামী এক বছরের মধ্যে যেসব স্কুল মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হবে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বৈধ-অবৈধ, যোগ্য-অযোগ্য সব শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বাদ দিয়ে দেওয়া কোনও বিকল্প নয়, এটি একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

বিচার কি শুধুই প্রতিষ্ঠানের নামে হয়?

একজন অভিভাবক বলছেন, ‘আমার সন্তানও এই দেশের নাগরিক। তারও অধিকার আছে নিজেকে প্রমাণ করার। তার বিদ্যালয় সরকারি না হোক, শিক্ষা তো সে একই বই থেকেই নিচ্ছে।’ একজন শিশুর হাতে নেই তার বিদ্যালয় বাছাইয়ের ক্ষমতা, তার অধিকার রয়েছে মেধা ও পরিশ্রমের আলোয় নিজের প্রতিভা প্রদর্শনের। কিন্তু আজকের এই সিদ্ধান্তে শিশুদের শিক্ষার আলোকে ভাগ করা হচ্ছে, যা নৈতিকভাবে অন্যায় এবং শিক্ষাগত অসাম্যের একটি ভয়ংকর নিদর্শন। যদি সেই ভিত্তি বৈষম্য ও অবিচারের দ্বারা টেকসই না হয়, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।

আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত পুনর্বিবেচনা করবে এই বিতর্কিত সিদ্ধান্ত। শিক্ষার অধিকার যেন সকল শিশুর জন্য সমান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক থাকে—এটাই আসল শিক্ষা নীতি। এক দেশে দুই শিক্ষা নীতি? না, হবে একাত্ম শিক্ষা নীতি—যেখানে বিচার হবে শুধুমাত্র শিক্ষার্থীর মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে। প্রতিষ্ঠানের নামে নয়।

 

লেখক: রাশেদুল ইসলাম রাশেদ,

সাংবাদিক ও শিক্ষক।

 


সর্বশেষ সংবাদ