প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণের যৌক্তিকতা

এম এ মতিন
এম এ মতিন  © টিডিসি ফটো

পাকিস্তান আমল থেকে পঞ্চম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার পর ‘প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা’ নামে একটি থানাভিত্তিক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা  অনুষ্ঠিত হতো। এই পরীক্ষা  ২০০৮ সাল নাগাদ চালু ছিল। পঞ্চম শ্রেণির বাছাই করা শিক্ষার্থীরা এই বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ পেত। কিন্তু এই পরীক্ষা  বাদ দিয়ে ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য শুরু হয় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা। এতে সব শিক্ষার্থীই বৃত্তি পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারতো। যদিও পিইসি পরীক্ষা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা ছিল। কারণ, এই পরীক্ষার নামে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। কোচিং-প্রাইভেটের প্রবণতা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ছোটদের এই পরীক্ষাতেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো ঘটনা ঘটেছে। যদিও করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং এরপর নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা বিবেচনায় পিইসি পরীক্ষা আর হয়নি।

প্রচলিত বৃত্তি পরীক্ষা উঠিয়ে দিয়ে সব শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক স্তরে ‘পিইসি’ এবং মাধ্যমিক স্তরে অষ্টম শ্রেণিতে জেডিসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) ও ‘জেডিসি’ (জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা চালু করা হয় যথাক্রমে ২০০৯ ও ২০১০ সালে। এ দুটি বৃত্তি পরীক্ষা সবশেষ ২০০৮ ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

বৃত্তি পরীক্ষার সাথে অবশ্য প্রাথমিকের সকল পরীক্ষাই বাদ দেয়া হয়। এর পরিবর্তে ছাত্রছাত্রীদের দৈনন্দিন পড়াশুনার ভিত্তিতে ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয়। এই পদ্ধতি পরবর্তীতে ছাত্রশিক্ষক, গার্জিয়ান, শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞসহ সমাজের সকল পর্যায়ের মানুষের মধ্যে তীব্র সমালোচনা ও  বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। ছাত্রশিক্ষক গার্জিয়ানগণ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করেন, গণ মাধ্যমে প্রচুর লেখালেখি  হয় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরীক্ষাবিহীন পাশ পদ্ধতি বাতিল করে পূর্বতন পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করেন এবং তাতে মানুষজন শান্ত হয় বলে প্রতীয়মান হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার বাতিলকৃত প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা চালুরও ঘোষণা দেন। আমাদের বিশ্বাস, সরকার জনমতের ভিত্তিতেই শুধু নয়, বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে, এই পরীক্ষার ভাল-মন্দ বিবেচনা করেই এটি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু  একটি মহল বলছেন, এই পরীক্ষা নেওয়া হলে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। তারা আরও বলছেন, এই পরীক্ষা নেওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। বরং সামগ্রিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় সমতা ও গুণগত মান উন্নত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট আরও কেউ কেউ এই পরীক্ষা গ্রহণে  আপত্তি করেছেন। তাঁদের মতে, এই পরীক্ষা বাস্তবে শিশুদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং এটি শিশু বিকাশেরও পরিপন্থী। এতে মেধাবী ও অমেধাবী, এমন একটি বিভাজনও তৈরির আশঙ্কা আছে।

তবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এই পরীক্ষা আগেও একসময় নেওয়া হতো। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বাড়ে ও তাতে মানে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা আর্থিকভাবেও উপকৃত হয়। ২০২২ সালে বছরের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে আকস্মিকভাবে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও তখনো বিশেষজ্ঞরা সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে বৃত্তি পরীক্ষা নেয়। কিন্তু এরপর ওই বৃত্তি পরীক্ষার ফল নিয়ে ব্যাপক ভুলভ্রান্তির ঘটনা ঘটে। আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ২০২৩ সালেও বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও শেষমেশ তা আর হয়নি। এখন আবারও সেই আগের পথেই হাঁটছে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ।

প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্দেশ্যে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ৯ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই কমিটির প্রধান ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এই কমিটি সরকারের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। কমিটি পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা নেয়ার কোনো বিষয়ে সুপারিশ করেনি।

কমিটির প্রধান অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো সুপারিশ না করলেও তাঁরা মূল প্রতিবেদনের আলোচনায় বলেছেন প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সমতা ও মান — এই দুটো লক্ষ্যের ওপর কোনো প্রভাব রাখে না। বরং কিছুটা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। কারণ, আগের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বিদ্যালয়গুলো তখন কেবল যারা বৃত্তি পরীক্ষা দিতে পারে, এমন শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষকেরা বেশি মনোযোগ দেন। বরং এলাকাভিত্তিক দরিদ্র নির্ধারণ করে উপবৃত্তির ওপর জোর দেওয়া দরকার।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীও মনে করেন, প্রাথমিক বৃত্তি নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। অতীতে এসব পরীক্ষার মাধ্যমে নানা রকমের নেতিবাচক প্রবণতাই দেখা গেছে। নির্ধারিত সংখ্যক শিক্ষার্থীকে নিয়ে এই পরীক্ষা নেওয়া হলে তা কোটার ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হবে; যা বৈষম্য বাড়াবে।

দীর্ঘ ১৬ বছর পর আবার আগের নিয়মে চালু হতে যাচ্ছে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা। এ বছর থেকেই ডিসেম্বরের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে পৃথকভাবে এই বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পাশাপাশি ট্যালেন্টপুল ও সাধারণ — দুই ধরনের বৃত্তির অর্থ বাড়ানোর পাশাপাশি বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সর্বশেষ বৃত্তিতে ৩৩ হাজার শিক্ষার্থী ট্যালেন্টপুল এবং ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন সাধারণ বৃত্তি পেয়েছিল। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক কোটা পদ্ধতিতে এই বৃত্তি দেওয়া হয়। সর্বশেষ প্রতিটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মোট শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষা গ্রহণের বিপক্ষে যে সব যুক্তি দেয়া হচ্ছে সেগুলোর খুব একটা সারবত্তা আছে বলে মনে হয় না। বলা হচ্ছে এই পরীক্ষা গ্রহণের ফল ভাল’র চেয়ে মন্দই বেশি হবে। আবার বলা হচ্ছে, এতে ফলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে, মাত্র ১০% ছাত্রছাত্রী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ পেলে কোটা পদ্ধতিই বহাল থাকলো। শিক্ষকরা শুধু বৃত্তি পরীক্ষার্থীদের প্রতি মনোনিবেশ করবেন সাধারণ ছাত্রদের প্রতি অতটা যত্নবান হবেন না। কোচিং সেন্টারের প্রভাব বেড়ে যাবে, ইত্যাদি।

কিন্তু আমরা মনে করি, শিক্ষার সার্বজনীনতা বা শিক্ষায় সকলের অন্তর্ভুক্তির বিষয় উন্নয়ন সহযোগী বা দাতা সংস্থার অগ্রাধিকার হলেও শিক্ষার গুণগত মান রক্ষার জন্যে শিক্ষার সকল স্তরে নিবিড় বাছাই/পরীক্ষা পদ্ধতি চালু রাখা দরকার। ঝরে পরা কম দেখানোর জন্যে পরীক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে শিক্ষার মানকে বিসর্জন দেয়া জাতির জন্য কোনোক্রমেই কল্যাণকর নয়।

তাই  সরকার প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষা চালুর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা সঠিক এবং যথার্থ।  এই পরীক্ষা চালু হলে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও গার্ডিয়ানদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং সংশ্লিষ্টরা তাদের ছেলেমেয়েদের প্রতি অধিকতর যত্ন নেয়ার বিষয়ে আগ্রহী হবেন। ছাত্রছাত্রীরা একটি বিশেষ লক্ষ্য সামনে রেখে লেখাপড়ার কাজে ব্রতী হবেন। ভালো এবং মন্দের বিভাজন হওয়া দরকার। তাহলে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে কীভাবে? আর প্রতিযোগিতা থাকলেই উত্তম ফলাফল আশা করা যায়। পবিত্র কোরআন শরিফে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘যারা জানে আর যারা জানে না – তারা কি সমান’? (সুরা আয্‌-জুমার, আয়াত: ৯)

লেখক: উপদেষ্টা, গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগ ও প্রক্টর, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, আশুলিয়া এবং প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক-প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি), সাভার, ঢাকা।
ই-মেইল: amatin@aub.ac.bd


সর্বশেষ সংবাদ