কর্মসংস্থান, অর্থনীতি ও শিক্ষাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ‘সাইবার ক্রাইম’ বাড়ছে: ড সাজ্জাদ সিদ্দিকী

ঢাবির শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী
ঢাবির শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী  © সংগৃহীত

বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন যেন এক নতুন ‘তথ্য যুদ্ধের ময়দান’। দিন দিন বাড়ছে ভুয়া ফটোকার্ড এবং এআই সৃষ্ট ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা, যেখানে মিথ্যাই হয়ে উঠছে প্রচারের হাতিয়ার, আর সত্য হারিয়ে যাচ্ছে অ্যালগরিদমের ভিড়ে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কালিমালিপ্ত করা, জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বকে বিতর্কিত করা, কিংবা কোনো ইস্যুতে জনমতকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য এখন ব্যক্তিগত এবং সংগঠিতভাবে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তিকর কার্ড, ভিডিও ও এআই-জেনারেটেড কনটেন্ট, যেগুলো দেখতে অবিকল মূলধারার গণমাধ্যমের প্রকাশনার মতোই। এসবই যেন বিশ্বাসযোগ্যতার ছদ্মবেশে ছড়ানো এক বিভ্রান্তির ফাঁদ।

কী কারণে আসলে মানুষ এসব সাইবার ক্রাইমে জড়িত হচ্ছে সে বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান ও সমাজ বিশ্লেষক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী। তিনি বলেছেন, আমাদের দেশে কর্মসংস্থান, অর্থনীতি ও শিক্ষাকে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যার কারণে, ‘অপ্রয়োজনীয়’ একটি জনগোষ্ঠী আপনা-আপনিই তৈরি হয়ে গেছে। আর তারাই বিভিন্ন এসব কাজে (সাইবার ক্রাইম) জড়াচ্ছে। তাছাড়াও, আইনের প্রয়োগ না থাকা এই অবস্থাকে দিচ্ছে বেপরোয়া গতি।

সম্প্রতি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা ও অপ্রীতিকর তথ্য ছড়ানোর সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর দিক হলো— এগুলোর মাধ্যমে নীতি-নৈতিকতাবিহীন একটি প্রজন্ম গড়ে উঠছে, যেখানে মিথ্যা ও অর্ধসত্য গুরুত্ব পাচ্ছে, আর প্রকৃত অপরাধ ও অপরাধীরা থেকে যাচ্ছে আড়ালে। তৃতীয় বিশ্বের, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের, মানুষ মেটাফোরিক কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে কন্টেন্ট বানাতে গিয়ে কোথায় থামতে হবে বা কতটুকু করলে নীতিবিরোধী হবে, তা জাতিগতভাবে তারা অর্জন করতে পারেনি।

তিনি বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় সরকার প্রধানকেও ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন কিংবা এআইভিত্তিক নেতিবাচক কন্টেন্টে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু তাদের কনটেক্সটে তারাও একটা লিমিট রাখে। এমনকি, তাদের রিলিজিয়াস বা সোশ্যাল ভ্যালুজ পোস্ট-মর্ডানিটির নেতিবাচক দিকগুলোর সাথে কম্প্রোমাইজ করতে গিয়ে তাদের কাছে নুডিটি (নগ্নতা) একরকম স্বাভাবিক বিষয়। এসব দেশে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে অস্ত্র কেনা যায়, কিন্তু আমাদের দেশে গাজা বহন করাও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। পাবলিক স্পেসে প্রকাশ্যে ধূমপান অপরাধ হলেও তা নারী ধূমপায়ীর জন্য ‘মহা অপরাধ’। 

আরও পড়ুন: ভুয়া ফটোকার্ড ও এআই কনটেন্টে মিথ্যার ‘মহামারি’, ধ্বংসের মুখে সামাজিক সংহতি

তার মতে, পশ্চিমা বাস্তবতার বিপরীতে, তাদের মতো এসব কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের চর্চা বাংলাদেশে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তারপরও যখন সমস্যাটি বাড়তে শুরু করেছে, তখন সবার মাঝেই একটা নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে, কেউ উচ্চমাত্রায় সফল বা পরিচিত হলে তার নিরাপত্তাহীনতা বেশি হয়ে যাচ্ছে, যেটি হওয়া উচিত ছিল না। কিন্তু এটা হচ্ছে জাতি গঠনের আগেই ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ইনসেন্সিবল জনসাধারণের কারণে। 

অপতথ্য ছড়ানোর অপতৎপরতা বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, দেশে আমরা বড় একটা অংশকে চাকরি ও ভালো জীবনযাপনের সুযোগ দিতে পারিনি। যারা অপতথ্য ছড়ায় তাদের বেশিরভাগেরই সোশ্যাল সিকিউরিটি, লাইবেলিটি, এমপ্লোয়েবিলিটি ও অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি নেই এবং ইকোনোমিক্যালি ভালনারেবল থাকায় কেবলমাত্র পলিটিক্যাল প্রভাব ও স্লোগানের মাধ্যমে বেনিফিট নিয়ে ডিসইনফরমেশন ও ফেইক নিউজ ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা এবং সমাজে, বিশেষ করে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামাজিক গণ্ডিতে, নিজের একটা অবস্থান তৈরি করার কাজটি করে থাকে। অর্থাৎ এসব কাজের (সাইবার ক্রাইম) পেছনে দায়ী প্রধানত অর্থনীতি ও শিক্ষা। আমাদের দেশে কর্মসংস্থান, অর্থনীতি ও শিক্ষাকে কখনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যার কারণে, ‘অপ্রয়োজনীয়’ একটি জনগোষ্ঠী আপনা-আপনিই তৈরি হয়ে গেছে। আর তারাই এসব কাজে জড়াচ্ছে। তাছাড়াও, আইনের প্রয়োগ না থাকা এই অবস্থাকে দিচ্ছে বেপরোয়া গতি।

ড. সিদ্দিকী আরও বলেন, বাংলাদেশে এথিক্স মেনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে এমন লোকের সংখ্যা ২-৩ শতাংশের বেশি হবে বলে আমার মনে হয় না। ঠিক তেমনি, পিস জার্নালিজম আমাদের মূল ধারার সাংবাদিকতায় প্রায় অনুপস্থিত। এমন একটি সোসাইটিতে যখন কোটি কোটি মানুষকে অবাধ ইন্টারনেটের সুযোগ দেওয়া হয়, তখন বেপরোয়াত্ব ও বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বাড়ার বিষয়টিকে অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনার সুযোগ কম। এক্ষেত্রে, চীনসহ অনেক দেশই রেস্ট্রিকটেড সিস্টেম চালু করেছে। এরকম সিস্টেমের মাধ্যমে অপতথ্য ছড়ানোর মহামারি প্রতিরোধ করা যেতে পারে। কারণ, এ সিস্টেমে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে কে কী ক্রাইম করছে, তা নিরূপণ করা করা সম্ভব। আর সে অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে সন্তোষজনক সমাধান সম্ভব।

 


সর্বশেষ সংবাদ