প্রাপ্যতা নেই, তবুও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সম্মানীতে ব্যয় দেড় কোটি টাকা
- শিহাব উদ্দিন
- প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৪০ PM , আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:২৮ AM
প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং এর নিয়ন্ত্রণাধীন পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সম্মানি বাবদ প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে এ খাতে মোট ১ কোটি ৪৯ লাখ ৮৮ হাজার ১০২ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়েছে। সম্প্রতি শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে এ অনিয়মের তথ্য সামনে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পরিপত্র অনুযায়ী, রুটিন কাজের জন্য সম্মানি প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। অথচ নিয়ম ভেঙে নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্মানি খাতে ৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ব্যয় করেছে সংস্থাটি। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে—যে প্রতিষ্ঠান অন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করবে, তার নিজের ভেতরেই যদি একই ধরনের অনিয়ম হয়, তবে উচ্চশিক্ষা খাতে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে কীভাবে?
সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিষ্ঠানটি তিনটি খাতে আলাদা আলাদাভাবে ৯ লাখ থেকে শুরু করে ৩৪ লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানি বাবদ ব্যয় করেছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই মোট ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ৯০ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে। এছাড়া গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২ লাখ ৬৪ হাজার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ লাখ ৬৩ হাজার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ লাখ ১৯ হাজার এবং জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির অডিট শাখার পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) নাহিদ সুলতানা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘যে সব বিষয়ে আপত্তি এসেছে, কমিশন সে সব বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা অভিযুক্তদের কাছে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা বা মতামত নিয়েছি। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। পরবর্তীতে রিপোর্ট আকারে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হবে।’
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরীক্ষণ কাজ, পরীক্ষার পারিতোষিক, ভিসি অফিস, কোষাধ্যক্ষ দপ্তর, হিসাব পরিচালকের কার্যালয়, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরসহ বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তরের নিয়মিত কাজকে সম্মানী খাতে দেখিয়ে টাকা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সরকারের প্রায় দেড় কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
নিরীক্ষায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিষ্ঠানটি তিনটি খাতে আলাদা আলাদাভাবে ৯ লাখ থেকে শুরু করে ৩৪ লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানি বাবদ ব্যয় করেছে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই মোট ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ৯০ লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।
এছাড়া গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩২ লাখ ৬৪ হাজার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ লাখ ৬৩ হাজার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ লাখ ১৯ হাজার এবং জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকার অনিয়ম ধরা পড়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, এটি শুধু নিয়ম ভঙ্গ নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার বড় ঘাটতির প্রমাণ। কারণ, পরীক্ষা নেওয়া, ফলাফল প্রকাশ বা বিভিন্ন কমিটির কাজ শিক্ষকদের নিয়মিত দায়িত্বের অংশ। অথচ সেগুলোকে বাড়তি কাজ দেখিয়ে সম্মানি তোলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শিক্ষকরা অনেক সময় রুটিন কাজের বাইরেও নানা ধরনের কমিটিতে যুক্ত থাকেন। তবে সেগুলোকে সম্মানি দিয়ে পুরস্কৃত করার বিধান নেই। এখানে যে অনিয়ম হয়েছে তা আসলে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। এ টাকা ফেরত আনা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।’
আরও পড়ুন: পোষ্য কোটার ধাক্কা, গুচ্ছে ৩২৭৪৩ মেধাক্রম নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ভিসি-কন্যা
এসব অনিয়মের বিষয়ে ইউজিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো জবাব দেয়নি। তারা পরবর্তীতে জবাব দেবে বলে জানিয়েছে।
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এ পর্যন্ত দেওয়া সম্মানী কর্তনপূর্বক প্রমাণক দাখিল করবে বলে জানিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, ‘তাদের সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত সিটিং অ্যালাউন্স নিয়ম মেনে দেওয়া হয়েছে।’ জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, ‘বর্তমানে তারা প্রধান বা বিশেষ অতিথিদের কোনো সম্মানি দেয় না, কেবল অতিথি যদি রিসোর্স পারসন হিসেবে থাকেন, তখন দেওয়া হয়।
অনিয়ম হওয়া সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালগুলোর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও ইউজিসি, ঢাবি ও পবিপ্রবি জবাব দেয়নি। জবাব না দেওয়া অডিট কোডের বিধি ৫৯ এবং ট্রেজারি রুলসের অধীনে প্রণীত সাবসিডিয়ারি রুলসের বিধি ৪৩৭ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে জানিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জবাব দিয়েছে, সেগুলোও আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য সহায়ক নয়। কারণ, বিধি বহির্ভূতভাবে সম্মানি প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। প্রতিবেদনে আপত্তিকৃত টাকা আদায় করে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমার সুপারিশ করা হয়েছে।
শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর্থিক শৃঙ্খলা না থাকায় এ ধরনের অনিয়ম নিয়মিত ঘটে আসছে। শিক্ষকদের রুটিন কাজকে সম্মানি খাতে দেখানো শুধু নিয়মভঙ্গ নয়, বরং এটি এক ধরনের আর্থিক দুর্নীতি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতিমধ্যেই আর্থিক ও শিক্ষাগত মান নিয়ে নানা সমালোচনার মুখে। সেখানে এই ধরনের আর্থিক অনিয়ম কেবল আস্থার সংকটই নয়, শিক্ষাক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাবকেও নতুন করে সামনে আনছে।
এসব ঘটনায় যদি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে ভবিষ্যতে আরও বড় অঙ্কের অর্থ অপচয় হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনই যদি এসব অনিয়ম রোধে শক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে উচ্চশিক্ষা খাতে অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এর ফলে গবেষণা, ল্যাব উন্নয়ন কিংবা ছাত্র-শিক্ষকদের প্রকৃত কল্যাণে বরাদ্দ কমে যাবে।