অক্সফোর্ড মডেল কী, জানলে তারা দাবি করত না: সাত কলেজ ইস্যুতে অধ্যাপক মামুন

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন  © সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেছেন, সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের এখনকার দাবি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মডেল ফলো করা হোক। ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছে, তারা কোনভাবেই সহশিক্ষা কার্যক্রম মেনে নিবে না। শিক্ষার্থীরা বলছে, এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় চাই যাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা না কমে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মডেল কী জানলে আমি নিশ্চিত এরা এই দাবি করত না।

সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তিনি এ মন্তব্য করেন। এসময় তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজিয়েট মডেল সম্পর্কেে আলোচনা করেন।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য অধ্যাপক মামুনের ফেসবুক পোস্টটি তুলে ধরা হল:

সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের এখনকার দাবি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মডেল ফলো করা হোক। ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছে তারা কোনভাবেই সহশিক্ষা কার্যক্রম মেনে নিবে না। শিক্ষার্থীরা বলছে এমন একটা বিশ্ববিদ্যালয় চাই যাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা না কমে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মডেল কী, জানলে আমি নিশ্চিত এরা এই দাবি করতো না।

প্রথমত শিক্ষার্থীরা জানেই না অক্সফোর্ডের কলেজিয়েট মডেল কি? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ‘কলেজ’ মূলত আবাসিক হল। তবে এইগুলোকে কলেজ বলা হয়, কারণ অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলো শুধুই আবাসিক হল না। এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এই কলেজগুলো আমাদের ৭ কলেজ বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কলেজের মত না।

অক্সফোর্ডের ৩০টিরও বেশি কলেজের কোনটিতেই পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত প্রভৃতি বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের জন্য আলাদা আলাদা বিভাগ নাই। এইসব বিভাগ কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিটি বিষয়ের জন্য একটি করে বিভাগ আছে। প্রতিটি কলেজের নিজস্ব প্রশাসন, আর্থিক তহবিল, লাইব্রেরি, টিউটোরিয়াল ব্যবস্থা, ডাইনিং হল, ছাত্রাবাস ও সামাজিক জীবন রয়েছে। এখানেই শিক্ষার্থীরা থাকেন, খান, এবং ফেলোদের কাছ থেকে একান্ত বা ছোট দলের টিউটোরিয়াল ক্লাসে অংশ নেন। এই টিউটোরিয়াল পদ্ধতিই অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজের শিক্ষাদর্শনের কেন্দ্রবিন্দু— যা দক্ষিণ এশিয়ার লেকচারনির্ভর মডেল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং শিক্ষার্থীদের একান্ত একাডেমিক পরামর্শদাতা পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে।

সুতরাং ৭ কলেজ যদি অক্সফোর্ড কলেজিয়েট মডেল অনুসরণ করে তাহলে ৭টি কলেজ হবে মূলত আবাসিক হল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এই কারণেই বলা হতো কারণ এখানকার আবাসিক হলগুলোর কনসেপ্ট ছিল একেকটি কলেজ। কিন্তু দিনে দিনে আমরা সেই মডেল থেকে যোজন যোজন দূরে সরে এসেছি।

আমাদের শিক্ষার্থীরা হয়ত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজিয়েট মডেল ফলো করার দাবি জানাচ্ছে। ইন ফ্যাক্ট, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও লন্ডন কলেজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয় মডেল মডেল অনুসরণ করেই করা হয়েছিল। এই মডেল অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজিয়েট মডেল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। লন্ডন কলেজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয় মডেলের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিংস কলেজ, ইম্পেরিয়াল কলেজ, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন প্রভৃতি। লন্ডন কলেজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কলেজ প্রায় সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত, নিজস্ব ভর্তি প্রক্রিয়া, শিক্ষক, নিজস্ব বিভাগ, শ্রেণীকক্ষ, শিক্ষক এবং ক্যাম্পাস পরিচালনা করে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হলো ডিগ্রি প্রদান এবং মান নিয়ন্ত্রণ, যা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে, শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ কলেজে পড়াশোনা করলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি পেত। তবে বর্তমানে খোদ ইংল্যান্ডেই এই মডেল ফলো করা হয় না। সময়ের সাথে সাথে কিছু কলেজ স্বাধীনভাবে ডিগ্রি প্রদানের ক্ষমতা অর্জন করেছে। এখন ইম্পেরিয়াল কলেজ, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন হলো ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং-এ ১ থেকে ১০ বা ১৫ এর মধ্যে থাকে। এই দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে রাস্তায় নামে না। কারণ নামে কি আসে যায়? শিক্ষকদের মান এবং সংখ্যা দিয়েই নির্ধারিত হয় প্রতিষ্ঠানের পরিচয়। তাহলে ৭ কলেজের শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে অক্সফোর্ড কলেজিয়েট মডেলই তারা চায় নাকি লন্ডন বা কলকাতা কলেজিয়েট মডেল চায়।

আরও পড়ুন: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক আইসিটি কোর্স চালু

যেই মডেলই শিক্ষার্থীরা চাক না কেন প্রতিটি কলেজ বর্তমানে যেই সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করে সেই সংখ্যক শিক্ষার্থীই ভর্তি করার দাবি জানালে এটি একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই হবে। দিন শেষে কেবল সার্টিফিকেট প্রদানের দোকান হবে প্রকৃত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে না। শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমাতে বললেই শিক্ষার্থীরা বলতে শুরু করে শিক্ষা সংকোচনের কথা বলা হচ্ছে। এখানেই থেমে নেই তারা। আরও বলে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বাধ্য করা হবে। তা কেন হবে? নতুন ২২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শুনেছি ভাড়া বাড়িতে কাজ চলছে। এখানেই থেমে নেই। শুনেছি ক্লাসরুমের জায়গা নেই, শিক্ষক নেই আবার যারা আছে তাদের বসার জায়গা নেই। লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি তো অনেক দূরের কথা। এই ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি যথেষ্ট ভালো মানের শিক্ষক দেওয়া হয় তাহলে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই যথেষ্ট শিক্ষার্থী ভর্তি করতে পারবে।

তার চেয়েও বড় কথা লেখাপড়া মানেই অনার্স মাস্টার্স সার্টিফিকেট না। দেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা বেকার সমস্যা। গত ১ বছরের বেশি সময় ধরে এই সরকার ক্ষমতায়। কোন ইফেক্টিভ উদ্যোগ দেখেছেন? শুধু যদি দুইটা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়কে ভারতের আইআইটি খড়গপুর মানের করতে পারতো তাহলেই দেখতেন বেকার সংখ্যা কমে যেত। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চীন, কোরিয়া জাপান থেকে শিক্ষক এনে মানসম্মত করুন দেখবেন বেকার সমস্যা কমে যাবে। শিক্ষায় বিনিয়োগের বিকল্প নেই। সংখ্যা বাড়াতে মান কমালে কোন সুফল দিবে না। এর জন্যও কি মানুষকে রাস্তায় নামতে হবে? একটি দেশের মোট শিক্ষার্থীর ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করা উচিত যা আমাদের দেশে মারাত্মক অবহেলিত। এই আন্দোলন সংক্রান্ত প্রত্যেকটা গ্রুপ হয় প্রচন্ড স্বার্থপর না হয় প্রচন্ড জানা বোঝার অভাব।

 


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!