ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব বাদ দেওয়ার চেষ্টা, আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে ষড়যন্ত্র কেন?

ড. কামরুল হাসান মামুন 
ড. কামরুল হাসান মামুন   © টিডিসি সম্পাদিত

বিভিন্ন পত্রিকা থেকে জানলাম, শিক্ষা উপদেষ্টা, শিক্ষা সচিবসহ আরও তিনজনের নামে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। এ উকিল নোটিশ পাঠিয়ে তারা মাধ্যমিক পর্যায় থেকে বিবর্তন তত্ত্ব বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাদের যুক্তি, বিশ্বের কোথাও নাকি নবম-দশম শ্রেণির কারিকুলামে এইটা থাকে না। কিন্তু আমি নিজেই যাচাই করেছি: আমার দুই কন্যার রেখে যাওয়া দুইজন লেখকের ইংরেজি মাধ্যম O-লেভেল জীববিজ্ঞানের বই দেখেছি।  সেখানে “Evolution and the Theory of Natural Selection” শিরোনামে সম্পূর্ণ একটি অধ্যায় রয়েছে। আধুনিক জীববিজ্ঞান, জেনেটিকস ও মলিকুলার বায়োলজি, ইকোলজি ও পরিবেশ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ের অন্যতম স্তম্ভ  হলো বিবর্তন। এটিকে পাশ কাটিয়ে, অবজ্ঞা করে বা বাদ দিয়ে কীভাবে বড় বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলী হওয়া সম্ভব? বড়জোর কোয়াক বিজ্ঞানী আর কোয়াক প্রকৌশলী হতে পারবে। এক কাজ করা উচিত। ও-লেভেল থেকে কীভাবে এটি বাদ দেওয়া যায়, তাদের উচিত আগে সেই চেষ্টা করা। হ্যাঁ, এইটা ঠিক যে ভারতে ধর্মান্ধ দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর নবম-দশম শ্রেণির থেকে বিবর্তন তত্ত্ব বাদ দেওয়া হয়েছে। তাহলে আমরা কি ভারতকে অনুসরণ করব নাকি বাকি দুনিয়ার উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করব?

বস্তুত, যুক্তরাজ্যের O-লেভেল/GCSE জীববিজ্ঞান পাঠ্যক্রমে, ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব স্পষ্টভাবে শেখানো হয়। ও-লেভেল পাশ শেষে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হয় যে তারা: ১) ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব বোঝবে এবং কীভাবে এটি অভিযোজন ও প্রজাতির উদ্ভব ব্যাখ্যা করে তা জানবে। ২) ডারউইনের ধারণাকে পূর্ববর্তী তত্ত্বের সঙ্গে তুলনা করবে, যেমন লামার্কের। ৩) বিবর্তনের প্রমাণ যেমন জীবাশ্ম, DNA, এবং প্রজাতির মধ্যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে শিখবে। ৪) বিবর্তন কীভাবে জীববৈচিত্র্য ও শ্রেণিবিন্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত তা অধ্যয়ন করবে। বড়ই আশ্চর্যের বিষয় হলো কোন শিক্ষাবিদ এর প্রতিবাদে একটি কথা বললেন না। দেশে সত্যিকারের স্কলারের এতই অভাব? নাকি স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে চুপ?

বিবর্তন তত্ত্ব সম্পর্কের অনেকের মারাত্মক ভুল ধারণা আছে। অনেকে মনে করে ডারউইন তত্ত্ব বলে মানুষ বানর থেকে এসেছে অর্থাৎ বানরের ঔরসে মানুষ জন্মেছে। এমনটা ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব কখনোই বলেননি। ডারউইনের মতে, মানুষ ও আধুনিক বানর উভয়েরই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল, যে লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করত। আধুনিক বিজ্ঞান তো বলে ইউনিভার্স সৃষ্টির অনেক অনেক বছর পর পৃথিবী নামক গ্রহের জন্ম। ইউনিভার্স এর বয়স ধরা হয় আনুমানিক ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আর পৃথিবীর বয়স হলো আনুমানিক ৪.৫৬ বিলিয়ন বছর। পৃথিবী সৃষ্টির সাথে সাথেই কি প্রাণী জন্মেছিল বা মানুষ জন্মেছিল? পৃথিবীর জন্মের প্রায় ১ বিলিয়ন বছর পরে প্রথম এক কোষী প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সেটা ছিল মহাসমুদ্রের অতল গভীরে। এরপর অনেক বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়ে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর আগে সমুদ্র থেকে ভূমিতে প্রাণের জন্ম নেয়। আর মানুষ এসেছে ৩ লক্ষ বছর আগে। আর তারও অনেক মিলিয়ন বছর আগে ছিল ডাইনোসর। মানুষ বানর থেকে এসেছে—এটি ভুল ধারণা।

একবার আমি কোথাও একটি ভিডিও দেখেছিলাম, ঠিক কোথায় তা মনে নেই। এক দল মানুষকে একটি দীর্ঘ লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল, যেখানে প্রথম জন ব্যতীত বাকি সবাইকে উল্টো দিকে মুখ করে দাঁড় করানো হয়েছিল। এরপর প্রথম ব্যক্তিকে একটি সংক্ষিপ্ত অভিনয় দৃশ্য দেখানো হয় এবং বলা হয় সে যেন উল্টো ঘুরে পরের ব্যক্তিকে তার দিকে মুখ করে ঘুরতে বলে সে সেই দৃশ্যটি তার জন্য অভিনয় করল। এরপর দ্বিতীয় ব্যক্তি তৃতীয় ব্যক্তিকে ডাকল, তার দিকে মুখ ফিরিয়ে তিনি যা দেখেছেন তা অভিনয় করে দেখাল এবং তৃতীয় ব্যক্তিকে বলল পরের জন্য তা অভিনয় করে দেখাতে। এভাবে এটি একের পর এক সবাই পর্যন্ত চলে গেল। লাইনের শেষের দিকে পৌঁছালে দেখা গেল, যে অভিনয় তারা পরের ব্যক্তির জন্য করল তা মূল দৃশ্য থেকে এতটা আলাদা হয়ে গেছে যে তা সম্পূর্ণ অচেনা হয়ে গেছে। এটাই বিবর্তন। এটি অভিনয়ের পরিবর্তে একটি বার্তাও দেওয়া যায়। একটি বার্তা দীর্ঘ লাইনে একটি ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে ফিসফিস করে প্রবাহ করলে যখন বার্তাটি লাইনের শেষের ব্যক্তির কাছে পৌঁছে, তখন তা মূল বার্তা থেকে অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটি দেখায় কীভাবে ছোট ছোট পরিবর্তন সময়ের সাথে মিলিত হয়ে বড় রূপান্তর ঘটায়।

যুক্তরাজ্যের প্রধান পরীক্ষাপ্রদানকারী বোর্ডগুলো—AQA, Edexcel, OCR—সমস্তেই GCSE জীববিজ্ঞানে “Evolution and inheritance” কে মূল বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে।  আমাদের বাংলাদেশের যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে তারা নবম-দশম শ্রেণীতে এইগুলো পড়ে। তাহলে কেন মানুষকে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র? আপনারা চান না সেটা বলতে পারেন। দাবি করতে পারেন। সময় এখন আপনাদের। আপনারা দেশের ছেলেমেয়েদের বিশ্ব থেকে বিযুক্ত করতে চান। আপনারা চান এরা আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান না শিখুক। ভালো তো। দেশটাকে কোন পথে নিতে চাচ্ছেন? কিন্তু ইংরেজি মাধ্যম থেকে তো বাদ দিতে পারবেন না। তাহলে ধনীর ছেলেমেয়েরা যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়বে তারা এই বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাবে কিন্তু যারা বাংলা মাধ্যম ও অন্যান্য ধারার ছেলেমেয়েরা না পড়ুক সেটা চান? এই পদক্ষেপ কি দেশের শিক্ষাকে সঠিক পথে এগিয়ে নেবে? শুধুই বিবর্তন তত্ত্ব? তাহলেতো big bang থেকে শুরু করে আধুনিক কসমোলোজি (যার জন্য আমাদের জামাল নজরুল ইসলাম বিখ্যাত ছিলেন) ইত্যাদিও বাদ দিতে হবে। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কোন দিকে ধাবিত করার ষড়যন্ত্র চলছে? এটা আমাদেরকে ভাবতে হবে। মানুষ যখন বিজ্ঞান দিয়ে, যুক্তি দিয়ে জেনে বুঝে ধর্ম পালন করবে, সেটাই হবে সত্যিকারের ধার্মিক হওয়ার পথ।  অন্ধ বিশ্বাস করলে সৃষ্টিকর্তাও তাকে ভালোবাসবেন না।

ড. কামরুল হাসান মামুন: অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়   


সর্বশেষ সংবাদ