পোষ্য কোটার অস্তিত্বই মূলত নির্লজ্জতা ও অসভ্যতার প্রতীক
- ড. কামরুল হাসান মামুন
- প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:০৭ PM , আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬:১৪ PM
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পোষ্য কোটার অস্তিত্বই মূলত নির্লজ্জতা ও অসভ্যতার প্রতীক। বিশেষ করে শিক্ষকদের সন্তানদের জন্য আলাদা পোষ্য কোটা থাকা একেবারেই নৈতিকতাবিবর্জিত একটি প্রথা। এ প্রথার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর প্রকৃত যোগ্যতা ও মেধা যাচাই না করে তার বাবার পেশা বা মর্যাদা দিয়ে বিচার করা হয়। এটি অত্যন্ত সাংঘাতিক ও অযৌক্তিক ব্যাপার। যে শিক্ষক নিজের সন্তানকে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তুলতে ব্যর্থ হন, তার সন্তানকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে জায়গা করে দেওয়া শিক্ষকতার নৈতিকতার সঙ্গে যায় না। প্রশ্ন হলো, এমন অন্যায্য কোটা প্রথা চালু হলো কীভাবে? এর পেছনে মূল কারণ শিক্ষক রাজনীতি, শিক্ষক সমিতির ক্ষমতার লড়াই এবং ডিন কিংবা প্রশাসনিক পদে নির্বাচনের সমীকরণ। এ নির্বাচনী রাজনীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশনের নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশন এতটাই সহজ হয়ে গেছে যে তা এখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড থেকে বহুদূরে সরে গেছে। এই অবস্থা বদলাতে হলে শিক্ষকতার পেশায় স্বচ্ছতা, যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ ও নীতিগত দৃঢ়তা ফিরিয়ে আনা ছাড়া বিকল্প নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন গত ১০০ বছরে কমতে কমতে এতটাই কমে গেছে যে, এখন মেধাবীরা কেউ আর এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান না। ফলে নিম্নমানের শিক্ষার্থীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন। যার ফলে অধিকাংশ শিক্ষকের কোনো আত্মসম্মানবোধ নাই। না ব্যক্তিগত আত্মসম্মানবোধ আছে, না আছে কালেক্টিভ আত্মসম্মানবোধ। আত্মসম্মানবোধহীন মানুষ খুব স্বার্থপর হয়। তারা কেবল নিজের লাভ দেখেন। এর ফলেই কোটা সিস্টেমের উদ্ভব। উন্নতমানের শিক্ষক থাকলে, উন্নত আত্মসম্মানবোধের শিক্ষক থাকলে এই কোটা সিস্টেমের জন্মই হতো না। ভর্তির ক্ষেত্রে আর্থিক ও নানা কারণে পিছিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য সামান্য কোটা থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সন্তানদের কোটা সিস্টেম কেন থাকবে?
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা কি কেবল কোটা সিস্টেম? আরও অনেক সমস্যা আছে। আমাদের শিক্ষকরা যে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পার্ট টাইম পড়ান, এটা সমস্যা না? শুধু নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে না। গত ২০ বছরে ধীরে ধীরে আরেক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। সেটা কী? নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই পার্ট টাইম শিক্ষক হওয়ার সিস্টেম। আগে প্রতিটি বিভাগ মনে করলে অন্য কোনো বিভাগের ছাত্ররা মাইনর হিসাবে অন্য বিভাগে কোনো বিষয় পড়তে চাইলে পড়তে পারতেন। যেমন আমি গণিত ও পরিসংখ্যান সাবসিডিয়ারি হিসাবে পড়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই অংশ। উন্নত বিশ্বে কোনো একটি বিষয়ের কোর্সের জন্য মেজর এবং মাইনর ছাত্রদের জন্য আলাদা সিলেবাস হয় না। সবার জন্য একটা সিলেবাস হয়। সেই কোর্সে অন্য বিভাগের ছাত্ররা যদি পড়তে চান, পড়তে পারবেন। যেমন পদার্থবিজ্ঞানের কোনো ছাত্র যদি অর্থনীতির কোনো একটা বিষয়ের ক্লাস করতে চান এবং একটা সেটার ডিমান্ড যদি টাইম-টেস্টেড হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া। তার জন্য ওই বিভাগের একজন শিক্ষককে পার্ট টাইম হিসাবে নিয়োগ দিয়ে পড়ানো ঠিক না। এখন গত ৩০ বছরে আমরা এই নিয়ম চালু করেছি কেন? কারণ শিক্ষকদের বেতন কম। শিক্ষকদের বেতন কম হওয়ায় আমরা আরও অনেক কিছুই সিস্টেমের অংশ বানিয়ে অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করেছি। যেমন নিজ কোর্সের প্রশ্ন প্রণয়ন, উত্তর মূল্যায়ন ইত্যাদির জন্যও টাকার ব্যবস্থা।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি যোগ্য শিক্ষক একটা থ্রেশহোল্ড মানের বেশি থাকত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সমস্যার উদ্ভবই হতো না। যোগ্য শিক্ষকের অভাবে যোগ্য শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছেন না। যার প্রতিফলন আমরা প্রতিনিয়ত সমাজের সর্বত্র দেখছি। ভালো মানের শিক্ষার্থী পেতে হলে ভালো মানের শিক্ষক দরকার আর ভালো মানের শিক্ষক পেতে হলেও ভালো মানের শিক্ষার্থী দরকার। এটা একটা সমীকরণের মতো। বাংলাদেশের কোনো সরকারই এই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এক দিনে এই সমস্যা যেমন তৈরি হয়নি, আবার এক দিনেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না। তবে শুরু না করলে তো কোনো দিন সমাধানই সম্ভব না। এই সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করবে এই জাতির উন্নয়ন। মুখে মুখে উন্নয়ন নয়। আমি বলছি সত্যিকারের টেকসই উন্নয়ন। সত্যিকারের টেকসই উন্নয়ন চাইলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে এক নম্বর প্রাধান্য দিতে হবে। যত দিন এটা না হবে এই ধরনের কোটা সিস্টেম থাকবেই।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে যোগ্য শিক্ষক নাই তার প্রমাণ চান? বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচক–২০২৫-এ বিশ্বের ১৩৯টি দেশের মধ্যে দেশটি ১০৬তম স্থানে অবস্থান করছে। এই তালিকায় ঘানা এবং কেনিয়ার অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। বৈশ্বিকভাবে তাদের অবস্থান যথাক্রমে ১০১ ও ১০২তম। অথচ আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, শিক্ষকের সংখ্যা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে অনেক বেশি। আমরা কেবল সংখ্যার দিক দিয়েই বেশি। আমাদের মান যে কতটা খারাপ তা শুধু এই একটা ইনডেক্স দেখলেই প্রমাণিত হয়। গত ৫৪ বছরে আমরা কেবল বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষণা সেন্টার বানিয়েছি। এত দ্রুত আইন জারি করার মতো করে ধপাধপ বিশ্ববিদ্যালয় বানানোই প্রমাণ করে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় মানে কী সেটাই বুঝিনি। সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে ব্রিটিশ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মের ইতিহাস জানতে ও পড়তে হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার ইতিহাস জানলে মুড়ি-মুড়কির মতো বিশ্ববিদ্যালয় গজাতো না। যেমন ধরুন ৭ কলেজ নিয়ে সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয় বানানো। ইতিমধ্যেই নাকি ছাত্র ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে? সিলেবাস তৈরি হয়েছে? কিছুই হয়নি। এখনো প্রশ্ন জাগছে কলেজের বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের কী হবে?
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সংকট কেবল কোটা সিস্টেমেই সীমাবদ্ধ নয়, এর মূলে রয়েছে যোগ্য শিক্ষকের অভাব, স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার অভাব এবং টেকসই নীতিগত দুর্বলতা। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সংখ্যায় বাড়িয়ে নয়, মানে উন্নয়ন ঘটিয়ে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে। আর এজন্য জরুরি হলো—যোগ্য শিক্ষক তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করা, মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা। অন্যথায় উন্নয়নের স্লোগান যতই জোরালো হোক, প্রকৃত টেকসই উন্নয়ন অধরাই থেকে যাবে।
ড. কামরুল হাসান মামুন: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়