একজন শিক্ষার্থী তত্ত্ব মুখস্থ করলেও ব্যবহার করতে না পারলে সে জ্ঞান স্থবির

অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন  © ফাইল ফটো

আইজ্যাক নিউটন ছিলেন নিঃসঙ্গ চিন্তাশীল, তার কোনো ব্যবহারিক দক্ষতা ছিল না। আইনস্টাইনের কোন ব্যবহারিক দক্ষতা ছিল না। সক্রেটিসের কোনো ব্যবহারিক দক্ষতা ছিল না। হেগেল কোনো ব্যবহারিক দক্ষতা রাখতেন না, কিন্তু তাঁর চিন্তাভাবনা ও দর্শনের গভীরতা বিশ্বকে নতুনভাবে বোঝার পথ দেখিয়েছে। স্টিফেন হকিং শারীরিকভাবে সীমাবদ্ধ ছিলেন. তার কোনো ব্যবহারিক দক্ষতার সুযোগই ছিল না। ব্দুস সালাম মূলত একজন ভাবুক বিজ্ঞানী ছিলেন—তারও কোন বাস্তব দক্ষতা ছিল না। 

এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যাদের হাতে কোনো ব্যবহারিক স্কিল ছিল না, তবুও তাঁদের ধারণা ও তত্ত্ব মানবজাতিকে এমন পথ দেখিয়েছে। তারা জ্ঞানের ফ্রন্টিয়ারকে প্রতিনিয়ত ধাক্কা দিয়ে সামনে নিয়েছেন। এই ব্যক্তিরা ছিলেন আসল ‘ভাবনার কারিগর’—যাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, তত্ত্ব গড়েছেন, এবং বিশ্বকে নতুনভাবে বোঝার সুযোগ তৈরি করেছেন। যে রাস্তা এমন মানুষ তৈরি করে, সেই রাস্তাকে সম্মান করতে জানতে হবে। 

উচ্চ মানের চিন্তাশীল মানুষের সংখ্যা কম হবে কিন্তু এই মানুষ তৈরির রাস্তা জারি রাখতে হবে তবেই দেশ সামনে আগাবে। এদের অসম্মান করলে সামনে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বুয়েট কেমন মানুষ তৈরি করেছে? বুয়েট তৈরি করেছে এফ আর খান। তাঁর দূরদর্শিতা, সৃজনশীল নকশা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা তাকে বাংলাদেশে স্থাপত্যের ক্ষেত্রে একটি কিংবদন্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁকে প্রায়শই ‘স্থাপত্যের আইনস্টাইন’ বলা হয়, কারণ তিনি জটিল স্থাপত্য নকশায় বৈজ্ঞানিক চিন্তা ও শিল্পের নিখুঁত সমন্বয় দেখিয়েছেন।

বুয়েট তৈরি করেছে ফাজলে হুসাইন। তিনি ফ্লুইড ডাইনামিক্সের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিখ্যাত গবেষক। তরল প্রবাহ এবং জটিল ফ্লুইড সমস্যার গবেষণায় তাঁর অবদান অসাধারণ। বুয়েট সায়িফ সালাহউদ্দিনের মতো প্রতিভাবান বিজ্ঞানী তৈরি করেছে, যিনি আজ ক্যালটেক-এর ফ্যাকাল্টি এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক। এ রকম আরও অসংখ্য নাম নেওয়া যাবে, যারা বিশ্বের নামিদামি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি। এরা জ্ঞানের ফ্রন্টিয়ার দেয়ালকে সামনে নিয়ে যায়। যাদের নাম এখানে নিলাম তারা দক্ষতার চেয়ে জ্ঞানের জন্য বেশি বিখ্যাত।

তবে পৃথিবীটা কেবল কল্পনার না। বাস্তব জীবনে কোনো কাজকে সফলভাবে সম্পন্ন করতে দক্ষতাকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই। বাস্তব জীবনে জ্ঞান এবং দক্ষতার সঠিক সমন্বয় অপরিহার্য। কেবল জ্ঞান থাকলেই বা কেবল দক্ষতা থাকলেই কাজের পূর্ণতা আসে না। দক্ষতা ছাড়া জ্ঞান হলো হাতে মানচিত্র থাকলেও পথিক না থাকা—দিকনির্দেশ পাওয়া যায়, কিন্তু যাত্রা শুরু হয় না। একজন শিক্ষার্থী যত তত্ত্ব মুখস্থ করুক, যদি সে সেগুলো ব্যবহার করতে না পারে, তবে সেই জ্ঞান স্থবির। অন্যদিকে, জ্ঞান ছাড়া দক্ষতা হলো দিকহীন পথচলা—কেউ দ্রুত কাজ করতে পারলেও, গভীর বোঝাপড়া না থাকলে সৃজনশীলতা, উন্নয়ন বা দীর্ঘমেয়াদি ফল আসে না।

আরও পড়ুন: ‘যেই হারে মেধাবীরা দেশ ছাড়ছে, এই দেশের কোন ভবিষৎ দেখি না’

আসল সাফল্য তখনই আসে যখন জ্ঞান ও দক্ষতার সমন্বয় ঘটে। জ্ঞান আমাদের দেয় ভিত্তি, দৃষ্টিভঙ্গি এবং বোঝাপড়ার কাঠামো; দক্ষতা সেই জ্ঞানকে বাস্তবে রূপ দেয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন চিকিৎসকের শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক জ্ঞান যথেষ্ট নয়; তার থাকতে হবে রোগ নির্ণয়, শল্যচিকিৎসা এবং অন্যান্য ব্যবহারিক দক্ষতা। তেমনি, একজন প্রকৌশলীকে তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি প্রযুক্তিগত দক্ষতাও অর্জন করতে হয়। যেই শিক্ষায় শুধু দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, সেটাকে বলা হয় টেকনিশিয়ান। তাদেরকেও মূল্যায়ন করতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে তারা পেতে পারে অধিক বেতন তাদের স্কিলের কারণে।

আসল কথা একাই জ্ঞান বা একাই দক্ষতা যথেষ্ট নয়। এদের সংমিশ্রণই জন্ম দেয় সক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও অগ্রগতি। যে সমাজ এই সমন্বয় নিশ্চিত করতে পারে, সেই সমাজ কেবল দক্ষ মানুষই তৈরি করে না; বরং উদ্ভাবন ও টেকসই উন্নয়নের পথও উন্মোচন করে। পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টিশীলতার মূল উৎস হলো জ্ঞান—কেবল দক্ষতা দিয়ে নয়। জ্ঞান নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়, আর দক্ষতা সেই জ্ঞানকে স্বল্প সময়ে, কম খরচে এবং কার্যকরভাবে বাস্তবে রূপান্তরিত করে।

মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় দুটি ধরনের অবদান স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে—একটি হলো দক্ষতার অবদান, অন্যটি হলো ভাবনার অবদান। দৈনন্দিন জীবন, প্রযুক্তি বা কারিগরি উন্নয়নে দক্ষ মানুষের ভূমিকা নিঃসন্দেহে অপরিসীম। কিন্তু সভ্যতার মহাপরিকল্পনা, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব এবং বিশ্বদর্শনের বিকাশ ঘটিয়েছেন প্রায়শই সেই ব্যক্তিরা, যাঁদের হাতে কোনো ব্যবহারিক দক্ষতা ছিল না।

অতএব, সভ্যতার আসল অগ্রদূতরা তাঁরা, যাঁরা হয়তো ব্যবহারিক দক্ষতায় সীমিত ছিলেন, কিন্তু যাঁদের জ্ঞান ও চিন্তাভাবনা অন্যদের দক্ষতাকে দিশা দেখিয়েছে। দক্ষতা এবং জ্ঞানের সমন্বয় ছাড়া মানব সভ্যতার অগ্রগতি অসম্পূর্ণ থেকে যেত।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং সিনেট সদস্য

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)


সর্বশেষ সংবাদ