‘প্রকৌশলী’ পদ ব্যবহার ও নিয়োগে কোটা বিতর্ক––পাল্টাপাল্টি আন্দোলনের নেপথ্যে

প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন  © বিবিসি বাংলা

বিএসসি নাকি ডিপ্লোমা–– কোন ডিগ্রিধারীরা ‘প্রকৌশলী’ পদবি ব্যবহার করতে পারবেন? চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে দশম গ্রেডের উপ-সহকারী পদটি সবার জন্য কেন উন্মুক্ত নয়? আর নবম গ্রেডে নিয়োগ পরীক্ষা বা পদোন্নতিতে বৈষম্যের অভিযোগ কতটা যৌক্তিক–– কেন আসছে এসব আলোচনা? প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন ঘিরে এমন কয়েকটি প্রশ্নই সামনে আসছে।

মঙ্গলবার শাহবাগে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের পর বুধবারও আন্দোলনে নামেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ কর্মসূচিতে বুয়েটের পাশাপাশি যোগ দেন আরও কয়েকটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের কর্মসূচি ঘিরে রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় অশান্ত পরিস্থিতিও তৈরি হয়।

দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যেতে চাইলে টিয়ার শেল, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় পুলিশ। শিক্ষার্থী-পুলিশ মুখোমুখি অবস্থানে আহত হন বেশ কয়েকজন। পরে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনেই অবস্থান নেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীরাও এদিন পাল্টা দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছেন। তারাও গাজীপুরসহ দেশের কয়েকটি স্থানে সড়ক অবরোধ করে ক্ষোভ জানিয়েছেন।

চাকরির বাজারে প্রবেশ এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্যের অভিযোগ এনেছে দুই পক্ষই। এছাড়া পেশাগত মর্যাদা এবং যোগ্যতার ক্ষেত্রে ‘কে কার থেকে বড়’ এই প্রসঙ্গও তুলে এনেছে আন্দোলনকারীরা। বৈষম্য রয়েছে বলে দাবি করেছেন শিক্ষক ও পেশাজীবীরাও।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জিএম সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিএসসি ইঞ্জিনিয়াররা যদি যোগ্য হয় তাহলে কেন তাদেরকে দশম গ্রেডে পরিক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে না? একজন যদি নবম গ্রেডে চাকরির পরীক্ষা দিতে পারে, ১৩তম গ্রেডের পরীক্ষা দিতে পারে, তাহলে দশম গ্রেডে কেনো পারবে না?’

কোনো ধরনের কোটা নয়, বরং মেধার ভিত্তিতেই চাকরির নিয়োগ হওয়া উচিত বলে অভিমত দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মেধার ভিত্তিতেই চাকরির নিয়োগ হওয়া উচিত। পদোন্নতি পরীক্ষার মাধ্যমে হোক। যার যোগ্যতা থাকবে সেই সুযোগ পাবে। একটি পদ তাদের জন্য ব্লক করে রাখা তো বৈষম্য’।

বিএসসি ডিগ্রিধারীদের দাবিকে 'অযৌক্তিক' বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র শিক্ষক পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আলী আকবর সরকার, তিনি বলেন, ‘একটি মিমাংসিত বিষয় নিয়ে ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়াররা অযাচিত আন্দোলন করছে’।

এদিকে জটিলতা নিরসনে একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। বিএসসি ডিগ্রিধারী ও ডিপ্লোমাধারী ব্যক্তিদের পেশাগত দাবির যৌক্তিকতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এক মাসের মধ্যে সরকারের কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেওয়ার কথা রয়েছে এই কমিটির।

জটিলতা তৈরি হয়েছে যেখানে
ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রকৌশলী পেশায় বিএসসি ডিগ্রি এবং ডিপ্লোমাধারীদের বিদ্যমান জটিলতা বেশ পুরনো। এই সমস্যা নিরসনে অতীতের অনেক সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও সমাধান মেলেনি। উল্টো প্রতিবারই এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি আন্দোলনে নেমেছে দুই পক্ষ। মূলত এইচএসসি সম্পন্ন করে বুয়েট, চুয়েট ও কুয়েটের মতো প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।

আর এসএসসি বা এইচএসসি পাশ করার পর, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে প্রকৌশল বিষয়ে চার বছর বা তিন বছর ছয় মাস মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স সম্পন্ন করেন ডিপ্লোমাধারীরা। জটিলতার শুরুটা হয় চাকরির বাজারে গিয়ে। প্রকৌশল পেশায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে দশম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে কেবল ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরাই আবেদন করতে পারেন।

এরপর চাকরির অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতার ভিত্তিতে নবম গ্রেডে পদোন্নতি হয়। এক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ কোটা বা সুবিধাও পান তারা। এ ছাড়া ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরা বিএসসি সম্পন্ন করে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমেও নবম গ্রেডের চাকরিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। অন্যদিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি শেষ করে বিসিএসের মাধ্যমে নবম গ্রেডে অথবা ১১-১৬ তম গ্রেডে চাকরির সুযোগ পেলেও দশম গ্রেডে আবেদনের কোনো সুযোগ পান না বিএসসি ডিগ্রিধারীরা।

এ প্রক্রিয়াকে বৈষম্যমূলক উল্লেখ করেই আন্দোলনে নেমেছেন বিএসসি ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা। তাদের প্রশ্ন, দশম গ্রেডে শুধুমাত্র ডিপ্লোমাধারীরাই কেনো সুযোগ পাবে? প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, দশম গ্রেডের নিয়োগ পরীক্ষায় শুধু ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ায় বৈষম্যের শিকার তারা। এছাড়া নবম গ্রেডে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের ৩৩ শতাংশ কোটাভিত্তিক পদোন্নতির সুযোগ চাকরির বাজরের ভারসাম্য নষ্ট করেছে বলেও দাবি তাদের।

ডিপ্লোমাধারীদের নামের সঙ্গে প্রকৌশলী পদবী ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিএসসি শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, উচ্চপদগুলো আগেভাগেই দখল হয়ে থাকায় নবম গ্রেডের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পদের সংখ্যা অনেক কম থাকে। যার ফলে চাকরির বাজারে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে বিএসসি শিক্ষার্থীদের। এক্ষেত্রে চাকরি না পেয়ে নিরূপায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী দেশের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে বলেও দাবি তাদের।

ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা বলছেন, দেশের বিপুল সংখ্যক ডিপ্লোমাধারীর চাকরির অনিশ্চয়তা দূর করতেই দশম গ্রেড তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তাদের দাবি, ১৯৭৮ সালে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘উপ-সহকারী প্রকৌশলী’ পদ সৃষ্টি করে সরকার। এছাড়া সহকারী প্রকৌশলী পদে ৩৩ শতাংশ পদোন্নতির বিষয়টিও নির্ধারণ করা হয়। পদোন্নতি ও প্রকৌশলী পদবী ব্যবহারের বিষয়ে আইন ও বিধির প্রসঙ্গ টানছেন তারা।

পদোন্নতির ব্যাপারে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা-১৯৮১ এবং প্রকৌশলী পদবী ব্যবহারের ক্ষেত্রে ২০২০ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) এর গেজেটের কথা উল্লেখ করছেন ডিপ্লোমাধারীরা। ওই গেজেটে, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে উত্তীর্ণদের প্রকৌশলী ও স্থপতি হিসেবে এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে থাকা বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে উত্তীর্ণদের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও ডিপ্লোমা আর্কিটেক্ট হিসেবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

এসব যুক্তিতে দশম গ্রেডে শুধু ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত এবং নবম গ্রেডে পদোন্নতিতে ৩৩ শতাংশ নির্ধারিত সুবিধা বহালসহ সাত দফা দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা। ২০১৩ সালেও একই দাবিতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে নেমেছিল এই দুই পক্ষ। সেবারও উল্লেখযোগ্য কোনো সমাধান ছাড়াই আন্দোলন শেষ হয়।

বৈষম্যের অভিযোগ
প্রকৌশল পেশায় যোগ্যতার মানদণ্ড নিশ্চিত করা এবং নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অসমতা দূর করতে আন্দোলনে দেশের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বলছেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে উন্মুক্ত লিখিত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত এবং ডিপ্লোমাধারীদের জন্য সংরক্ষিত ৩৩ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা বাতিল করা হোক।

তাদের দাবি, এ ধরনের কোটা ব্যবস্থা মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপন্থী এবং এটি দেশের প্রকৌশল ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার ঘাটতি সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার আমহেদ বলছেন, ‘দেশে এমনিতেই চাকরির সংকট। তার ওপর এই ধরনের বৈষম্যমূলক পদ্ধতি আমাদেরকে হতাশার মধ্যে ফেলছে।’

আরও পড়ুন: দেশের সব প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ ঘোষণা

তার দাবি, ‘নবম গ্রেডের সহকারী প্রকৌশলী পদগুলো অনেকাংশেই উপ-সহকারী প্রকৌশলীদের পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ হয়ে যায়। আমরা তো ওই পদে আবেদনই করতে পারি না। আমরা চাকরির বাজারে চরম বৈষম্যের শিকার।’

এদিকে ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘প্রকৌশলী অধিকার আন্দোলন' ব্যানারে অযৌক্তিত ও নীতি বিরুদ্ধ দাবি তুলেছেন বিএসসি ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীরা। কোনভাবেই তাদের জন্য নির্ধারিত দশম গ্রেডের কর্মক্ষেত্র বাতিল করতে দেওয়া হবে না বলেও জানান তারা। সাবেক ডিপ্লোমা শিক্ষার্থী অভিজিত বিশ্বাস বলেন, পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ কোটার বিষয়টি পুরোপুরি ঠিক না।

‘উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর পদ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পদোন্নতির সুযোগ কমে ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এছাড়া অনেক প্রকৌশল সংস্থা ও বিভাগে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য নতুন পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে না’, দাবি করেন তিনি।

বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র শিক্ষক পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আলী আকবর সরকার বলেন, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের পদোন্নতির সুযোগ কম। ২৫ বছর চাকরি করে তারা একটি অথবা দুটি পদোন্নতি পান বলেই সরকার তাদের জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। ‘আপনি তো নবম গ্রেডে চাকরি নিয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্ত হইতে পারতেছেন, কিন্তু দশম গ্রেডে যারা করে তারা যাবে কোথায়? ওনারা নবম গ্রেডে আছে, প্রয়োজনে আরও নতুন পদ সৃষ্টি করে ওপরের দিকে যাবে কিন্তু নিচের দিকে নামবে কেন।’

এছাড়া সারা দেশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সংখ্যার বিপরীতে চাকরি স্বল্পতার বিষয়টিও বিবেচনায় রাখার কথা বলছেন তিনি। তাঁর ভাষ্য, বিএসসি ডিগ্রিধারী দেশে তিন থেকে চার লাখ কিন্তু ডিপ্লোমাধারী ২০ লাখ। এতগুলো মানুষ তাহলে কোথায় যাবে?’ বিবিসি বাংলা।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence