বিজয় মিছিলে গুলিতে প্রাণ হারান ভ্যানচালক জসিম, বাবার দাফনে যেতে পারেনি ছেলে
- আরফান আলী, শেরপুর প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৫, ০৯:২১ AM , আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৪:৩৫ PM
৫ আগস্ট ২০২৪। ঢাকার উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের রাজপথে বিজয়ের উল্লাসে মেতেছিল ছাত্র-জনতা। কোটা সংস্কার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে রাজধানীর রাজপথজুড়ে গর্জে উঠেছিল মানুষের ঢল। সেই মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন শেরপুরের দরিদ্র ভ্যানচালক জসিম মিয়া (৪০)। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। পরদিন, ৬ আগস্ট, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারান। ৭ আগস্ট গ্রামের বাড়ি শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে দাফন করা হয় তাকে।
জসিম মিয়ার জন্ম হয়েছিল শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার এক দরিদ্র পরিবারে। পিতা ছিলেন মৃত আবুল কাশেম মুন্সি, মাতা ছুরতব বানু। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে জসিম ছিলেন সবার ছোট। দারিদ্র্যের কষাঘাতে বড় হওয়া জসিম জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকায়। সেখানে ভাড়া ভ্যান চালিয়ে চালাতেন সংসার।
বছরের বিভিন্ন সময় বিশেষ করে ঈদে গ্রামে ফিরে আসতেন সন্তানদের কাছে। পরিবারের কাছে তিনি ছিলেন নির্ভরতার আরেক নাম। কিন্তু ২০২৪ সালের সেই রক্তাক্ত আগস্টের এক বিকেল চিরতরে কেড়ে নেয় পরিবারটির স্বপ্ন।
আরও পড়ুন: গোলাগুলির দিন ডাইনিং টেবিলেই বসেছিলেন মা, নিহত ছেলেকে শেষ বিদায়ও জানাতে পারেননি
প্রথম স্ত্রী উশেদা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী ৫ আগস্ট পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে পরের দিন মারা যায়। মরার একদিন পর আমরা লাশ এনে গ্রামে দাফন করি। আমি স্ত্রী থাকাকালীন সময়ে আমার অজান্তেই ফরিদা বেগমকে বিয়ে করে। কিন্তু অনেকদিন ঘর সংসার করার পর ৪ বছর আগে ফরিদা নিজেই জসিম মিয়াকে তালাক দিয়ে চলে যায়। মৃত্যুর পর যখন আর্থিক অনুদানের কথা শুনে ফরিদা ঢাকায় গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে অনুদান নিচ্ছে। আমরা এসব অনুদান থেকে বঞ্চিত। আমার দুইটা ছেলে ঢাকায় কাজ করে কিছু টাকা পাঠায়, তা দিয়েই সংসার চলে।’
জসিম মিয়ার বড় ছেলে রাসেল মিয়া বলেন, ‘আমার আব্বা ঈদের সময় গ্রামে আসতো। আমাদের সাথে সময় কাটাইতো। আমি সাভারের আশুলিয়ায় একটা চায়না কোম্পানিতে চাকরি করতাম। ৫ তারিখে আমার এক ছোট ভাই ফোন করে বলে আব্বা পুলিশের গুলি খাইছে। আমি শোনার পর রওনা হই। গাড়ির মধ্যে হঠাৎ করে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তিন দিন অজ্ঞান অবস্থায় থাকার পর জ্ঞান ফিরলে দেখি আমার ফোন, মানিব্যাগ কিছুই নেই। আমি কেমনে আবার আশুলিয়া আসলাম তাও জানি না। পরে আব্বার জানাযায়ও যেতে পারি নাই। আব্বা আমাদের অনেক আদর করতো। আমার মেয়ের জন্য খেলনা কিনে দিতো। আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই।’
জসিমের মৃত্যুর এক বছরের মাথায় পরিবারটি আজ চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে। আর্থিক সংকট, ভাঙা সংসার এবং বিচারহীনতার দীর্ঘশ্বাস তাদের ঘিরে রেখেছে চারদিক থেকে। পরিবারটি দাবি জানিয়েছে—জসিম মিয়াকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।