গোলাগুলির দিন ডাইনিং টেবিলেই বসেছিলেন মা, নিহত ছেলেকে শেষ বিদায়ও জানাতে পারেননি

শহীদ জাহিদুজ্জামান তানভীন
শহীদ জাহিদুজ্জামান তানভীন  © টিডিসি সম্পাদিত

ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামের শহীদ জাহিদুজ্জামান তানভীন (২৬)। রাজধানীর উত্তরা আজমপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন তারা। বাবা ইঞ্জিনিয়ার মো. শামসুজ্জামান একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে অটোক্যাড অপারেটর হিসেবে কর্মরত। মা বিলকিস জামান গৃহিণী। বড় বোন জেসিকা জামান বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায়। তানভীন ছিলেন বাবা-মায়ের সবচেয়ে ভরসার জায়গা। সে সময় পড়াশোনার পাশাপাশি স্বপ্ন দেখতেন দেশকে বদলে দেওয়ার।

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ১৮ জুলাই প্রতিদিনের মতোই সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে ১২ টার দিকে বাসা থেকে বের হয়। বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যাওয়ার পথে সাড়ে ১২টা থেকে ১টার দিকে আজমপুরে স্ট্যান্ডার্ড চার্টারস এর অপজিটে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন তানভীন। সাথে থাকা বন্ধুরা তাকে মেডিকেলে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তানভীনকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে তানভীনের বন্ধুর ফোনে পাওয়া খবর অনুযায়ী মা দৌঁড়ে যান হাসপাতালে। কিন্তু গিয়েই দেখতে পান, ইমারজেন্সি কক্ষে নিথর পড়ে আছে তার ছেলের দেহ। 

তানভীন মারা যান দুপুর ১টা ১৩ মিনিটে। পরে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় উত্তরা আজমপুরের বাসায়। জানাজা শেষে গ্রামে নেওয়া হয় তাকে—সেই রতনপুরে, যেখানে শৈশব কেটেছে তার।

কান্নায় ভেঙে পড়া বিলকিস জামান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি তখনই অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান ফেরে, তখন হাসপাতালের ভেতরে শুধু হট্টগোল—ছাত্র আর পুলিশের সংঘর্ষ চলছিল।

তানভীনের মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘প্রতিদিন আমি ওকে দরজায় দাঁড়িয়ে বিদায় দিতাম, নিচে না যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু সেদিন জানি না কেন, বসে ছিলাম ডাইনিং টেবিলে। আজও চোখের সামনে ভাসে ওর মুখ। আমার ছেলের মধ্যে অনেক দেশপ্রেম ছিল। সবসময় বলত, বিদেশ থেকে মাস্টার্স করে ফিরে দেশের জন্য কিছু করব।’

জানা যায়, তানভীন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ফাইভ পেয়েছেন। গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ২০২২ সালে তিনি স্নাতক শেষ করেন। পরে তিনি তার তিন বন্ধুকে নিয়ে তাদের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে দেশের প্রথম এবং একমাত্র ড্রোন বিক্রি, বাণিজ্যিক আবেদন এবং সেবাসমূহের ‘অ্যান্টস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠানটি জরিপের নানা ধরনের কাজ করার পাশাপাশি অনলাইনে ড্রোন বিক্রিও করত। তানভীন এই প্রতিষ্ঠানে ‘চিফ টেকনিক্যাল অফিসার’ হিসেবে যুক্ত ছিলেন। ২০১৮ সালে বুয়েট নেভাল ডিপার্টমেন্টের আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেস্ট শিফট ডিজাইন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় তার দল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের প্রতিযোগিতাতেও দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করে। একাধারে ২০২০ ও ২১ সালে আননেমড এরিয়াল প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করে তানভীন ও তার দল।

এ ছাড়া বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ‘ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনএএসএ- নাসা) আয়োজিত ইউরোপিয়ান রোভার চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় তানভীন ও তার গ্রুপ বিশ্বের দশম এবং এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে। পরবর্তীতে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিক্যাল, মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রোডাকশন বিভাগের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী থাকাকালীন তানভীন বুয়েট আয়োজিত ‘মডেল শিপ প্রপালশান কম্পিটিশন ' এ অংশ নিয়ে পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর দেশের গণ্ডি পার হয়ে তিনি ও তার দল যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনস্টিটিউশন অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আয়োজিত ইউএএস এয়ারক্রাফট সিস্টেম কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন। এ কম্পিটিশনে ছয়টি পুরস্কারের মধ্যে তিনটিই লাভ করে তানভীন ও তার দল।

তানভীনের মা বিলকিস জামান বলেন, ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি গভীর মনোযোগ ছিল তার। প্রযুক্তিই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। প্রখর মেধাবী ছিল আমার তানভীন। সে কখনো কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। ড্রোন নিয়েই ব্যস্ত থাকত। আইসিটি ডিভিশনের অধীনে ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ড প্রতিযোগিতায় জিতে অনুদান পাওয়া ১০ লাখ টাকা দিয়ে ড্রোন বানানোর প্রতিষ্ঠান ‘অ্যান্টস’ নামক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলে।

আমার ছেলে অনেক বিনয়ী এবং ভদ্র ছিল। সে ড্রোন বানিয়ে নিজে বিক্রি করত। নানা ধরনের পুরস্কার পেয়েছে। দেশের বাইরে যেতে চায়নি। দেশে ও দেশের বাইরে ব্যবসা-বাণিজ্য করে সফল হতে চেয়েছিল। ওর আব্বু ওকে বিসিএস পরীক্ষা দিতে বলছিল। তানভীন বলেছিল,‘আমি ব্যবসা করব। কোনো দিনই সরকারি চাকরি করব না। তাহলে কেন বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেব?’

তার বাবা শামসুজ্জামান(৫২) ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং তার একমাত্র বোনও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। সে এখন আমেরিকাতে বাস করছে। আমাদের মামা ভাগিনার সম্পর্ক ছিল মধুর। বাসা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে থাকা বুথ থেকে টাকা তুলতে গিয়ে সে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হয়েছে।’

এ্যান্টস এর নির্বাহী কর্মকর্তা ও বন্ধু তাওসিফুল ইসলাম তওসিফ বলেন, ‘তানভিন এ্যান্টস এর টেকনিক্যাল সাইডটা দেখত। আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটা করা। খুবই ট্যালেন্টেড ইঞ্জিনিয়ার ছিল সে। অসম্ভব ভালো একজন মানুষও। মৃত্যুর আগের দিন ১৭ জুলাই রাত দশটা পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে ছিলাম। ১৮ জুলাই যেদিন ও চলে গেল সেদিনও কিছু ইন্টারভিউ নেয়ার কথা ছিল। পরে রাতে যখন শুনতে পারি দেশের সিচুয়েশন খুব খারাপ হয়ে গেছে তখন তা ক্যানসেল করে সিদ্ধান্ত নেই যে কালকে (১৮ জুলাই) কেউ অফিসে আসবো না। পরের দিন ওর আম্মু ওকে ব্যাংক থেকে টাকা তোলার জন্য পাঠিয়েছিল। এরপরে পৌনে একটার দিকে খবর আসে যে ওর গায়ে গুলি লেগেছে। পরে এক ফ্রেন্ড কল দিয়ে জানায় ও আর নেই।’

তাওসিফ আরও বলেন, ড্রোনের সম্প্রসারণ নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা ছিল। তানভীনকে ছাড়া এ প্রতিষ্ঠান হয়তো কখনোই দাঁড়াত না। অ্যান্টস বর্তমানে ড্রোনের পাইলটিং ও ম্যাপিং নিয়ে কাজ করে। অ্যান্টস বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি, কৃষি অধিদপ্তর, ঢাকা ওয়াসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে। তানভীন তার সৃজনশীলতা ও কর্মস্পৃহা দিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকদূর এগিয়ে দিয়ে গেলো। তাানভীন চলে যাওয়ায় এ খাতের অপূরণীয় ক্ষতি হলো।

তানভীন শহিদ হওয়ার পর তাই তার এলাকার গোল চত্বর পাঁচ মাথার মোড় গোদাগাড়ীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘শহিদ তানভীন চত্বর’। আগে এই চত্বরের নাম ছিল ফিরোজ গোল চত্বর। দুটি গাছও সেখানে লাগানো হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ