শহীদ রাকিবের জানাজা ঢাকায় করতে দেয়নি পুলিশ, লাশ নিয়ে যেতে চেয়েছিল ছাত্রলীগ

রাকিব হাসান
রাকিব হাসান  © টিডিসি সম্পাদিত

‘হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে গেলাম মোহাম্মদপুর জাকির হোসেন রোডে। ভাবলাম জানাজা দিয়ে ঢাকায় কবর দিব। জানাজার জন্য মানুষ জড়ো হলে পুলিশ এসে সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। জানাজা দেওয়া রাষ্ট্রবিরোধী কাজ; জঙ্গির আবার কীসের জানাজা? তাড়াতাড়ি এখান থেকে যা, না হলে গুলি করব। জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাড়াতাড়ি সন্তানের লাশ নিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। সন্তানের কবর তো দিতে হবে। আবার লাশ নিলাম অ্যাম্বুলেন্সে, গন্তব্য গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর। ঢাকা থেকে লাশ বাড়ি আনতে পথে পুলিশ, ছাত্রলীগ আর যুবলীগ ৯ স্থানে চেক করেছে। ঢাকার ভেতর এক জায়গায় যখন ছাত্রলীগ জানল পুলিশের গুলিতে মারা গেছে তখন তারা কাফন পড়ানো আমার মৃত সন্তানের লাশ নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি তাদের পায়ে ধরে লাশ ফেরত নেই।’ এভাবেই দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে কথাগুলো বলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ রাকিব হাসানের বাবা আবুল খায়ের। 

তিনি আরও বলেন, একবার চিন্তা করুন আমি কাফন পড়ানো লাশের পায়ের দিকে ধরে টানছি আর ওরা মাথার দিক ধরে টানছে। তাদের মধ্যে একজনকে মানুষ বলে মনে হয়েছে। সেই ছেলেটি আমাকে বলে, পথে কেউ আটকালে বলবেন, এক্সিডেন্টে মারা গেছে; তাহলে ছেড়ে দেবে। তারপর রাত বারোটার দিকে বাড়িতে পৌঁছাই। ততক্ষণে লাশ ফুলে উঠেছে। এরপর তাড়াতাড়ি জানাজা দিয়ে দাফন করি। একজন বাবার কাছে সন্তানের লাশ নিয়ে এভাবে হেনস্তার চ্বেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে !  

জানা গেছে, পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোডে থাকত রাকিব হাসান। সে আই টি জেড স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই পুলিশের গুলিতে শহীদ হয় রাকিব। 

ছেলে শহীদ হওয়ার বর্ণনা দিয়ে রাকিবের মা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ১৯ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে ফুটবল খেলার জন্য জার্সি গায়ে বেরিয়ে পড়ে রাকিব। বড় রাস্তায় গোলাগুলির শব্দ শুনে উৎসুক জনতার সাথে গলির মোড়ে গাছের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল রাকিব।পুলিশের গাড়ি আসলে আন্দোলনকারীরা দূরে সরে যায় আর রাকিব একা দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিশ কোন কারণ ছাড়াই ঠান্ডা মাথায় খুব কাছ থেকে মাথায় গুলি করে চলে যায়। রাস্তার পাশে গাছের আড়ালে পড়েছিল রাকিব, রক্তে সব ভেসে যায়।

তিনি বলেন, স্থানীয় কয়েকজন রাকিবকে রিকশায় তুলে হাসপাতালে পাঠায়। এর কিছুক্ষণ পরেই ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী আসে লাশ নিয়ে যেতে। লাশ না পেয়ে যে ছেলে রাকিবকে রিকশায় তুলে দিয়েছিল, তারা তাকে ধরে এলোপাতাড়ি কোপায়। এতে ওই ছেলেটিও শহীদ হয়। রাত নয়টার দিকে সিটি হাসপাতালে রাকিবকে খুঁজে পাই। সিটি হাসপাতাল থেকে রাকিবকে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা জানায় আরও আগেই রাকিব মারা গেছে। 

তিনি আরও বলেন, লাশ নিয়ে আসতে চাইলে শুরু হয় আরেক ঝামেলা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স ছাড়া লাশ দেওয়া হবে না। নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল যেহেতু শেরেবাংলা নগর থানার আওতাধীন, তাই সেখানে যাই। শেরেবাংলা নগর থানা ক্লিয়ারেন্স দিতে রাজি হয়নি যেহেতু ঘটনা ঘটেছে মোহাম্মদপু্রে। এরপর যাওয়া হয় মোহাম্মদপুর থানায়। সেখানে যাওয়ার পর তারা জানায় ক্লিয়ারেন্স  শেরেবাংলা নগর থানাকেই দিতে হবে যেহেতু লাশ ওই থানার অধীনে আছে। এরপর পুনরায় শেরেবাংলা নগর থানায় আসি। এভাবেই ওই রাত কেটে যায়।

রাকিবের মা আরও বলেন, ২০ তারিখ সকাল ছয়টার দিকে শেরেবাংলা নগর থানার কর্তব্যরত অফিসার উপরের লেভেলের সাথে কথা বলে রাকিবের বাবার কাছে একটা কাগজে স্বাক্ষর নেয়। তবে স্বাক্ষর দেওয়া কাগজে কী লেখা ছিল তা পড়তে দেওয়া হয়নি। এরপর লাশ পোস্টমর্টেম করার জন্য ঢাকা মেডিকেলে পাঠায়। হাসপাতালে  পৌঁছে দেখি সেখানে কোনো ডাক্তার নেই। ডোম বলেন, যে ডাক্তার রিপোর্ট দেবেন তিনি ফার্মগেটে আছেন। আপনারা গিয়ে তাকে নিয়ে আসুন, আমি পোস্টমর্টেম করে দিচ্ছি। 

তিনি বলেন, পোস্টমর্টেম শেষে লাশ  মোহাম্মদপুর নিয়ে গেলেও পুলিশি বাধায় জানাজা দিতে দেওয়া হয়নি। গুম করতে চেয়েছিল ছাত্রলীগ। শত বাধা আর অমানবিকতার মধ্যে ওইদিন লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার ৪ নং ইছাপুর ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডে মালগাজীবাড়ি নূরানী মাদ্রাসার পাশে পারিবারিক কবরস্থানে রাকিবকে দাফন করা হয়। 


সর্বশেষ সংবাদ