উত্তরার বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে গুলিতে মারা গেলেন সরকার রিপন
- জাবির আহম্মেদ জিহাদ, জামালপুর প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:২৯ AM , আপডেট: ০১ আগস্ট ২০২৫, ০৮:০৩ AM
জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার চরকাউরিয়া, সিমারপাড়—শান্ত এক গ্রাম, যেখানে রেডিওর শব্দে ভরতো দুপুর, ধানখেতের ফাঁকে উঁকি দিত স্বপ্ন, আর সন্ধ্যার আলোয় মিলিয়ে যেত দিনের ক্লান্তি। সেই গ্রামেই বড় হয়ে উঠছিল এক ছেলে—মো. সরকার রিপন। বাবার নাম রেজাউল করিম, পেশায় একজন সাংবাদিক। ছেলেকে বড় করছিলেন সত্য আর ন্যায়ের ভাষায়। ছেলে রিপনও সেই আলোর ভেতরেই মানুষ হচ্ছিল।
কিন্তু জীবন সবসময় কাব্য হয় না। সাংবাদিক বাবার ছেলেটি শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকতা করেনি। জীবিকার তাড়নায় ঢাকায় এসে যোগ দেয় একটি সিগারেট কোম্পানিতে, বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে। দোকানে দোকানে ঘুরতেন, টার্গেট মিলিয়ে দেখতেন, সিগারেটের প্যাকেটে হিসাব রাখতেন। কিন্তু ভেতরে ছিল অন্য কিছু—অভিমান, দ্রোহ, প্রতিবাদ আর ভালোবাসা। অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা, মায়ের মুখে একটু হাসি ফেরানোর অস্থিরতা, আর বাবার কলমে যে সাহস জন্মায়, সেটা বুকের ভেতর আগুন করে জ্বলতো।
২০২৪ সালের আগস্ট মাস। দেশজুড়ে উত্তাল কোটা সংস্কার আন্দোলন। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকার রাজপথে নেমে আসে বিজয়ের উল্লাস। উত্তরা ৬ নম্বর গেটেও ছিল এমনই এক বিজয় মিছিল। রিপনও সেখানে ছিলেন—কোনো দলের হয়ে না, কোনো সংগঠনের ডাকে না—শুধু একজন সাধারণ মানুষ হয়ে, যার বুকের ভেতর সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা ছিল।
আরও পড়ুন: ‘সেদিন ছেলেকে বই কিনে দিয়েছিলেন ফারুক, কিন্তু সেই বই আর পড়া হলো না’
সেই মুহূর্তে, যখন মানুষ হাসছিল, একে অপরকে জড়িয়ে ধরছিল, তখনই আকাশ কাঁপিয়ে ছুটে আসে গুলির শব্দ। মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় চারদিক। সেই গুলির একটিই গিয়ে লাগে রিপনের বুক চিরে।
একটা বুক—যেখানে ছিল বাবা-মার জন্য কিছু করার স্বপ্ন, যেখানে ছিল ছোট গ্রামের অন্ধকার ঘরকে আলোয় ভরিয়ে তোলার প্রতিজ্ঞা—সেই বুকই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে পড়ে থাকে রাজপথে। রক্তে লাল হয়ে যায় উত্তরার পিচঢালা সড়ক।
সাংবাদিক বাবা রেজাউল করিম কিছুদিন কলমই ধরতে পারেননি। তার চোখে চোখে শুধু ঘোর লেগে থাকতো, আর সিমারপাড়ের মানুষ বলে উঠতো—‘রিপন পলিটিক্স করতো না, সে মিছিলেও খুব একটা ডাকত না। কিন্তু তার চোখে আগুন ছিল—অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’
আরও পড়ুন: মৃত্যুর একদিন পর জঙ্গলে পাওয়া গেল মোস্তফার লাশ
আজও সিমারপাড়ের সেই বাড়ির উঠোনে নিঃশব্দে বাতাস বয়ে যায়। আর সেই বাতাসে যেন ভেসে বেড়ায় একটিই প্রতিধ্বনি— সত্যের জন্য দাঁড়িয়েছিলো যে ছেলেটি, তার বুকেই গুলি চললো কেন?
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।