‘সেদিন ছেলেকে বই কিনে দিয়েছিলেন ফারুক, কিন্তু সেই বই আর পড়া হলো না’

গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মো. ফারুক
গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ মো. ফারুক  © টিডিসি সম্পাদিত

জুলাই ২০২৪। সারা দেশের রাজপথ তখন উত্তাল ন্যায্য ভোটাধিকার, বৈষম্যহীন সমাজ এবং সকল শ্রেণির মানুষকে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে রাখার দাবিতে। ঢাকার রাজপথ থেকে গ্রামের অলিগলি—এক হয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষ আর ছাত্র-যুবকদের কণ্ঠস্বর। সেই মিছিলে কোথাও সামনে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, আবার কোথাও পেছন থেকে চোখে জল নিয়ে আশীর্বাদ জানাচ্ছিলেন এক বাবা—মো. ফারুক।

জামালপুর সদর উপজেলার ডেংগার নগর গ্রামের সন্তান মো. ফারুক। জন্ম ১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই। বাবা হাইদার আলীর সংসারে শৈশব থেকেই অভাবের সঙ্গে লড়াই ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন। লেখাপড়ায় খুব দূর এগোতে না পারলেও, পরিশ্রম আর দায়িত্ববোধে কেউ তার সমান ছিল না। কৃষিকাজে বাবাকে সাহায্য করা, ছোট ভাইবোনদের দেখভাল—সবই ছিল ছেলেবেলার অংশ।

স্বপ্ন ছিল ছোট—কিন্তু গভীর। পরিবারকে একটু ভালো রাখা, সন্তানদের মানুষ করা, এবং তার মতো আরেকজন যেন কষ্ট না পায় সেই পথ তৈরি করা। স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে জীবনের যুদ্ধে নেমেছিলেন ঢাকায়। কাজ শুরু করেন সাভারের একটি মুরগির দোকানে। মাসে মাত্র ১০ হাজার টাকা আয়। ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ, তারপর ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফেরা। তবু কখনো একটুও অভিযোগ করেননি ফারুক।

আরও পড়ুন: ‘রিয়াদ বাঁচলে বিসিএস ক্যাডার হতো, সব স্বপ্ন এক নিমিষে শেষ’

ছেলে মাহফুজ তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, আর মেয়ে তাবাসসুম অষ্টম শ্রেণিতে। তাদের বই কেনা, স্কুল ফি দেওয়া, টিফিনের খরচ—সবই ফারুকের ঘামঝরা টাকায় চলত। তিনি বলতেন, ‘আমার ছেলে-মেয়েই একদিন এই সংসারের ভাগ্য ফিরাবে।’

২০২৪ সালের ২১ জুলাই। সেদিন বিকেলে সাভার থানার মোড়ে চলছিল একটি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। ছাত্ররা বিক্ষোভ করছিল কোটা সংস্কার ও ন্যায্য ভোটের দাবিতে। হঠাৎ করেই শুরু হয় পুলিশের গুলিবর্ষণ। আতঙ্কে ছুটে আসে মিছিলকারীরা, আশ্রয় নেয় ফারুকের দোকানে। কিছু বোঝার আগেই একটি গুলি এসে বিদ্ধ করে ফারুকের মাথা। সাথে সাথেই তাকে নেওয়া হয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। সেদিন সন্ধ্যায় চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

স্ত্রী আজও সেই মুহূর্তের কথা মনে করে কাঁপতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘ফারুক কোনো রাজনীতির লোক না, সে তো দোকানদার। কিন্তু ছাত্ররা তার দোকানে লুকাইছিল, ও নিজে দাঁড়ায়া ছিল। গুলিটা তার মাথায় লাগে। আমার ছেলেটারে বই কিনা দিয়াইছিল সেদিন... সেই বই তো আর পড়া হইল না।’

মাহফুজ আর তাবাসসুম—আজ আর বাবার কোলে বসে হাসতে পারে না। কাঁধে বইয়ের ব্যাগ বয়ে যে যুদ্ধে তাদের বাবা নাম লিখিয়েছিলেন, সেই যুদ্ধে তারাই আজ অনাথ সেনা।

আরও পড়ুন: ‘স্বৈরাচার হাসিনা আমার সুখের সংসারটা তছনছ করে দিছে—আমি তার ফাঁসি চাই’

ডেংগার নগর গ্রামের মানুষজন বলেন, ‘ফারুক কখনো কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। দোকান থেকে লোকজন বাকি নিয়ে যেত, তাও কিছু বলত না। এমন মানুষকে কীভাবে গুলি করে মারা যায়?’

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।


সর্বশেষ সংবাদ