ছুটির দিনে সিন্ডিকেট সভার ডাক, ‘অস্বাভাবিক’ বলছেন শিক্ষক ও ছাত্রনেতারা

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়  © সংগৃহীত

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) আসন্ন শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে ছুটির দিনে সিন্ডিকেট মিটিং ডাকা নিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে উদ্বেগ ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপন্থীদের সম্পৃক্ত করা হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। ফলে ছুটির দিনে এমন সভা ডাকাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন তারা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে বলছে, ছুটিতে স্বাভাবিক নিয়মেই সভা ডাকা হয়েছে।

সম্প্রতি কর্মচারী নিয়োগে নিষিদ্ধ আওয়ামীপন্থী, তাদের স্বজন এবং নিজ এলাকার অনুগতদের নিয়োগের অভিযোগের পর, অনেকেই আশঙ্কা করছেন শিক্ষক নিয়োগেও একই ধারা পুনরাবৃত্তি হতে পারে। উক্ত নিয়োগে ১৪৫ জনের নিয়োগে শুধু উত্তরাঞ্চল থেকেই ৬৯ জন এবং ঢাকা অঞ্চল থেকে ২১ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসে প্রচলিত এলাকাভিত্তিক রাজনীতিতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও প্রক্টর ৩ জনই উত্তরাঞ্চলের এবং ট্রেজারার ঢাকা অঞ্চলের।

একাডেমিক ক্যালন্ডার অনুযায়ী ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শীতকালীন ছুটি ঘোষণা করা ছিলো। এর মধ্যেই ২৯ ডিসেম্বর সিন্ডিকেট সভা হতে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এবং সিন্ডিকেট সদস্য শেখ রেজাউল করিম জানান, আগামী সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) শিক্ষক নিয়োগকে অগ্রাধিকার দিয়েই সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করা হয়েছে। তবে এই সভা কেন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের দিনেই আয়োজন করা হচ্ছে সে প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব মেলেনি।

জানা গেছে, এ বছর ২৭ মার্চ প্রকাশিত একই বিজ্ঞপ্তিতে চাহিদা থাকলেও সোমবারের সভায় সীড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। এ বিভাগের নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনও সম্পন্ন হয়নি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

তবে এ সভাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা আশংকা করছেন, পূর্বের নিয়োগের মতো এবারও আওয়ামী সংশ্লিষ্টরা বিশেষ সুযোগ পেতে পারে।

এ বিষয়ে শেকৃবি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহ্বায়ক আসাদুল্লাহ নাইম বলেন, 'আওয়ামীলীগের সঙ্গে যুক্ত বা তাদের সমর্থক কাউকে নিয়োগ দেওয়া আমরা মেনে নেব না। আওয়ামী কেন্দ্রিক নিয়োগের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট। প্রশাসনকে আমরা জানিয়ে দিয়েছি—যাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগসূত্র রয়েছে, তাদের নিয়োগ হলে আমরা প্রতিরোধে যাব।'

বন্ধের দিনে সিন্ডিকেট মিটিং আয়োজন প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখে সিন্ডিকেট বসানো মানে স্বচ্ছতার প্রতি অবজ্ঞা। আমরা চাই নিয়মিত কর্মদিবসেই এসব সিদ্ধান্ত হোক।'

শেকৃবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক বি এম আলমগীর অভিযোগ করেন, '৭৫ জন কর্মচারী নিয়োগের কথা বলে প্রশাসন ১৪৫ জন কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে, যার অধিকাংশই আওয়ামী দোসর। কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই আওয়ামী দোসর শিক্ষকেদের সঙ্গে আতাত করে এসব নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন।'

তিনি আরও বলেন, 'এসব অনিয়মের বিচার না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগসহ কোনো নিয়োগ সংক্রান্ত সিন্ডিকেট বসানো ক্যাম্পাসে অশুভ পরিস্থিতি ডেকে আনবে। যাচাই-বাছাই ছাড়াই আগামীকাল ৪৫ জন শিক্ষক নিয়োগের সিন্ডিকেট আয়োজন করা জুলাই আন্দোলনে আহত ও নিহতদের সঙ্গে তামাশার শামিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।'

শেকৃবি শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবুল হাসান বলেন, 'বর্তমান সময়ে কোনো জরুরি পরিস্থিতি নেই যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের মধ্যেই শিক্ষক নিয়োগের জন্য সিন্ডিকেট মিটিং ডাকতে হবে। সার্কুলারের নয় মাস পরও আংশিক নিয়োগ দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়।'

তিনি আরও বলেন, 'এর আগে কর্মচারী নিয়োগের মতো শিক্ষক নিয়োগেও ফ্যাসিবাদের দোসররা সুযোগ পাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে এমনটা জানতে পেরেছি । আমরা প্রশাসনকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছি, ফ্যাসিবাদিদের অবশ্যই বাদ দিতে হবে এবং যোগ্যদের নিয়োগ সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় করতে হবে।'

এদিকে সোমবারের এ সিন্ডিকেট সভা নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন অন্য বিএনপিপন্থী শিক্ষকরাও। এমন তাড়াহুড়োকে ‘অস্বাভাবিক’ বলছেন তারা।

শেকৃবি সাদা দলের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. নাহিদ জেবা বলেন, 'বন্ধের দিনে শিক্ষক নিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিন্ডিকেট সভা ডাকা মানেই সন্দেহ তৈরি করা। গোপন কিছু না থাকলে খোলা দিনে সভা করতে আপত্তি কোথায়? আগের নিয়োগে নিষিদ্ধ আওয়ামীপন্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে—এই ইতিহাস আমরা ভুলে যাইনি। তাহলে জুলাই আন্দোলনের অর্জন কোথায়?' তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, 'একইসঙ্গে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে নিয়োগ প্রক্রিয়াও একসাথে হওয়ার কথা। কিন্তু এখানে অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করা যাচ্ছে।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপিপন্থী একাধিক শিক্ষকনেতা অভিযোগ করেন, 'এটা কোনো জরুরি পরিস্থিতি নয় যে ছুটির দিনেই সিন্ডিকেট করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগেও যদি কর্মচারী নিয়োগের মতো দলীয় বিবেচনা চলে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এই ভয় থেকেই যায়।' 

তারা আরও বলেন, 'এবার প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকেই সাদা দলের মূল দায়িত্বে আনা হয়েছে। ফলে প্রশাসনিক অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে অনেক শিক্ষক প্রকাশ্যে কথা বলতে পারছেন না। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ জমছে।'

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ বলেন, 'এখানে কোন লুকোচুরি হচ্ছে না। শীতকালীন বন্ধে ক্লাস কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অফিসিয়াল কার্যক্রম হিসেবে সিন্ডিকেট মিটিং এ কোন সমস্যা নেই। সার্কুলারের আংশিক নিয়োগ সম্পর্কে তিনি বলেন, সীড টেকনোলজির গভর্নিং বডি আলাদা। সেই গভর্নিং বডির রিপোর্টের পর আবার সিন্ডিকেট মিটিং হবে।  এলাকাপ্রীতি ও আওয়ামীলীগ সংশ্লিষ্টদের নিয়োগের আশঙ্কার প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, এখানে কোন বিশেষ সুবিধা নেয়ার সুযোগ নেই। কয়েক ধাপে পরীক্ষার মাধ্যমে যারা সর্বোচ্চ মেধাবী, তারাই নিয়োগপ্রাপ্ত হবে।'


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!