আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে শহীদ হলেন নিরীহ রিকশাচালক আকতার
- মামুন হোসাইন, ভোলা প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২৫, ০৩:২৫ PM , আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৫, ০৮:৪৮ AM
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। রাজধানী ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তখন উত্তাল জনপদ। সেই সকালটাও ছিল প্রতিদিনের মতোই। জীবিকার তাগিদে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকার ভাড়া বাসা থেকে অটোরিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন ভোলার ছেলে আকতার হোসেন (৩৮)। কিন্তু কে জানত, সেটিই হবে তার জীবনের শেষ সকাল?
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ধানমন্ডির রাস্তায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলা অবস্থায়। আহতদের সহযোগীতা করতে গিয়ে মুহূর্তেই পুলিশের ছোড়া চারটি গুলিতে শহীদ হন নিরীহ রিকশাচালক আকতার। বিকেলে স্ত্রী আকলিমা বেগম স্বামীকে জীবিত নয়, নিথর মরদেহ হিসেবে দেখতে পান। যে মানুষটি সকালে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছিল, বিকেলে তাকে কাপড়ে মোড়া হয়ে ফিরতে দেখে মূর্ছা যান তিনি।
আকতার হোসেনের বাড়ি ভোলার লালমোহনের কালমা ইউনিয়নের দক্ষিণ কালমা গ্রামের হমজুউদ্দিন বাড়িতে। বাবা বজলুর রহমান ব্যাপারী পেশায় দিনমজুর। ঢাকায় থেকে অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন আকতার। ১৫ বছরের সংসারে স্ত্রী আকলিমা বেগম ও দুই সন্তান—এক ছেলে, এক মেয়ে। মাসে মাত্র ১৫ হাজার টাকা আয় হলেও তাদের সংসারে ছিল হাসি, ছিল স্বপ্ন।
‘ভালো মানুষ রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন, ফিরে এলেন লাশ হয়ে’— ভাঙা কণ্ঠে বলছিলেন স্ত্রী আকলিমা। তিনি জানান, সেদিন এলাকা উত্তাল ছিল। আমার স্বামী ধানমন্ডি দিয়ে ফিরছিলেন। হঠাৎ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে পড়ে যায়। পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। চারটি গুলি লেগেছিল শরীরে। ভালো মানুষটা আর ফিরে এল না।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, আমার স্বামী তো কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি রিকশাচালক ছিলেন। তার কী অপরাধ ছিল? আমার বাচ্চাদের জন্য কিছু রেখে যেতে পারলেন না। আমি এখন মানুষের বাসায় কাজ করি, মাসে পাচ্ছি মাত্র ৫ হাজার টাকা। ঢাকায় এই টাকায় চলা অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়ে দুই সন্তানকে গ্রামে রেখে এসেছি। আমি শুধু চাই, আমার সন্তানেরা যেন না খেয়ে না থাকে।
নিহত আকতারের মেয়ে এখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে আর ছেলে প্রথম শ্রেণিতে। তারা কেউ-ই এখনো জানে না, কেন তাদের বাবা বাড়ি ফিরলেন না। তবে মায়ের চোখের পানি আর সবার মুখে মুখে বাবার নাম শুনে বুঝে গেছে তারা—এই ফেরা আর হবে না।
ছোট ছোট দুই নাতি-নাতনির ভবিষ্যৎ চিন্তায় উদ্বিগ্ন আকতারের বাবা বজলুর রহমানও। তিনি বলেন, আমি নিজে দিনমজুর মানুষ। নিজেরই খেয়ে-পরে চলতে কষ্ট হয়। ছেলেকে হারিয়েছি, এখন নাতি-নাতনিদের মুখের দিকে তাকিয়ে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সরকারের কাছে অনুরোধ, যারা আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই। সেই সঙ্গে ছেলের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য সরকারি সহায়তা দরকার।
তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলার পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের পাঙাশিয়া এলাকায়। সন্তানদের সেখানেই রেখে এসেছেন আকলিমা। কিন্তু প্রতিদিন তাদের মুখ মনে করে বুক ফেটে কান্না আসে তার। তিনি বলেন, ওরা এখনো জানে না তাদের বাবা কেমন করে মারা গেছে। আমি কিছুতেই বলতে পারি না। শুধু চাই, তারা যেন ভালো থাকে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহ আজিজ জানান, লালমোহন উপজেলায় আন্দোলনে শহীদদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সরকারিভাবে প্রতি শহীদ পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।