ফেসবুক থেকে ৪ বছর দূরে থাকা তাওফিক পেলেন চয়েস লিস্টের প্রথম ক্যাডার

এম. তাওফিক ইমাম খান। বেড়ে উঠেছেন রাজধানীর পুরান ঢাকায়। বাউণ্ডুলেপনা, দুষ্টুমিতে কেটেছে তার শৈশব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা দুরন্তপনা এ শিক্ষার্থী দ্বিতীয় বিসিএসে পেয়েছেন সাফল্য। ৪৪তম বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডারে হয়েছেন সুপারিশপ্রাপ্ত। তার বিসিএস জয়ের গল্প শুনেছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের—আমান উল্যাহ আলভী।
সাফল্য নিয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই
২০২১ সাল থেকে শুরু করা প্রস্তুতির ফল হাতে পেলাম ২০২৫ সালে। এ দীর্ঘ সময়ে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই আমার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। ধরেই নেন আমি বিসিএসের জন্য উপযুক্ত নই। এ সাফল্য একদিকে যেমন তাদের জন্য স্বস্তি এনেছে, আমার আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি আরও মজবুত করেছে। আমি এখন বিশ্বাস করি পরিশ্রম করলে আর ভাগ্য সহায় থাকলে সাফল্য অবধারিত।
আপনার শৈশব নিয়ে বলুন
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। আমি পুরান ঢাকার ছেলে। বাউণ্ডুলেপনা, দুষ্টুমিতে পরিপূর্ণ ছিল আমার শৈশব। পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো, বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে খেলাধুলা করা, টিফিন পিরিয়ডে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলতে যাওয়া ছিল আমার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই
ছোটবেলা থেকেই আমি পড়াশোনায় অমনোযোগী ছিলাম। ক্লাস ফোরে ইংরেজিতে ও গণিতে ফেল করে বাজে ছাত্রের তকমা পেয়েছিলাম৷ জেএসসি পরীক্ষাতে ৪.৫৭ পাওয়ায় আব্বু অনেক রেগে গিয়েছিলেন। আম্মুর কৃপায় ৩/৪ ঘণ্টা পালিয়ে থেকে সেবার মারের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। আমার শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল ব্যবসায় শিক্ষায় পড়া। আমি নিজে থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিই। ইচ্ছা ছিল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হব। এ এক সিদ্ধান্ত আমার জীবনকে পাল্টে দেয়। হিসাববিজ্ঞান, ফাইন্যান্স, ব্যবস্থাপনা বিষয়গুলো খুবই ভালো লাগত। ধীরে ধীরে পড়াশোনাও শুরু করলাম মন দিয়ে। তার প্রমাণও পেলাম হাতে-নাতে।
আরো পড়ুন: বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার কৃষিতে প্রথম হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিপক দেবনাথ
এসএসসিতে জিপিএ ৫.০০ পেয়ে চান্স পেয়ে যাই আমার স্বপ্নের নটর ডেম কলেজে। জীবন থেকে খারাপ ছাত্রের তমকা চিরতরে উধাও হয়ে গেল। সাধারণ গ্রেডে বৃত্তিসহ জিপিএ ৫.০০ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই। বেছে নিই আমার প্রাণের বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করি ২০২২ সালের আগস্টে।
প্রস্তুতির সময়টা কেমন ছিল?
২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের করাল গ্রাসে পৃথিবী যখন জবুথবু, সবকিছু যেখানে থমকে ছিল সেখান থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করি। আমাকে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন ৩৮তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মো. আসলাম সাগর ভাই। তিনি আমাকে হাতেকলমে শিখিয়েছেন কিভাবে পড়াশোনা করতে হয়। তিনি সবসময় বলতেন, ‘কী পড়তে হবে সেটার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কী বাদ দিতে হবে’। বিভিন্ন প্রকাশনীর বই থেকে বেছে এক সেট বই পড়েছিলাম প্রিলিমিনারির জন্য। বাংলা, বাংলাদেশ বিষয়াবলি, আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নোট করে পড়েছিলাম। মডেল টেস্টের বই কিনে বাসায় প্র্যাক্টিস করতাম। পাশাপাশি লাইভ এমসিকিউতেও পরীক্ষা দিতাম। আমি মনে করি প্রিলিমিনারির জন্য বেশি বেশি পরীক্ষা দেওয়া ও ভুলগুলো নিয়ে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই।
বিসিএস প্রস্তুতির বিশেষ কোনো টেকনিক ছিল কি না, কোন বিষয়টি আপনাকে প্রস্তুতি এগিয়ে রেখেছিল বলে মনে করেন?
বিসিএস পরীক্ষার তিনটি ধাপ-প্রিলিমিনারি, রিটেন ও ভাইভা। প্রতিটি ধাপকেই সমান গুরুত দিয়ে এগুতে পারলেই সফলতা আসবে। বিসিএস লিখিত পরীক্ষার জন্য বাজারের প্রচলিত গাইড বই কিনে নোট করে পড়তাম৷ এক্ষেত্রে আমি বিশ্বাস করি গাইড বই পড়ে সবাই মোটামুটি একই রকম লিখবে যেখানে নিজের স্বকীয়তা থাকেনা। নিজের স্বকীয়তা আসবে যখন আমার নিজের মত করে বানানো নোট থাকবে। লিখিত পরীক্ষার ১ মাস আগে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির ১৫-২০টা টপিক নিজের মত করে গুছিয়ে রাখতাম আলাদা একটি খাতায়। বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে মডেল লিখিত দিয়ে নিজেকে যাচাই করতাম।
মৌখিক পরীক্ষা একটি চ্যালেঞ্জিং ধাপ বলে বিবেচিত হয় কেননা প্রিলি ও লিখিতের মত কোনো ধরাবাধা সিলেবাস নেই এখানে। আমি এ চ্যালেঞ্জকে প্রবলভাবে গ্রহণ করি। বিসিএস ভাইভা ব্যাটল বইটি আমাকে বেশ সাহায্য করেছে। বইটির লেখক সালাউদ্দিন মিশন ভাই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেন। যে কোনো প্রশ্নের উত্তর উনি সুন্দরভাবে গুছিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির জন্য প্রিলিমিনারির পড়া, পাশাপাশি প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম। এভাবে প্রায় দুইমাস পড়েছিলাম। যার ফল পেয়েছি ভাইভা বোর্ডেই। ২৮টি প্রশ্নের ২৫টি-ই সঠিকভাবে দিয়েছিলাম। বোর্ড খুবই খুশি ছিল আমার পারফরম্যান্সে।
পরিবার সম্পর্কে কী বলবেন?
আমরা ৩ ভাই-বোন। ছোট ভাই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। সে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। ছোট বোন এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করব এ স্বপ্নটি দেখিয়েছেন আমার আব্বু। তিনি মৃতুবরণ করার ৫ দিন আগে আমার থেকে ওয়াদা নেন যে আমি পুলিশে যোগদান করে দেশসেবা করব। মানুষকে সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে কাজ করব। আমি অত্যন্ত খুশি যে বাবার স্বপ্ন পুরণ করেছি। আক্ষেপ শুধু একটিই যে আব্বু দেখে যেতে পারলেন না। আমার ছোট মামা আমাকে অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। হাল ছাড়তে দেননি কখনোই। আমার মা ও আমার স্ত্রী আমার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাদের খুশি করতে পেরে ভালো লাগছে।
ক্যাডার চয়েজ আপনি কীভাবে দিয়েছিলেন? কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে ক্যাডার চয়েজ দেওয়া উচিত?
ক্যাডার চয়েজের ক্ষেত্রে আমি বিসিএস পুলিশকে প্রথমে রেখেছিলাম। আমি মনে করি যে ক্যাডারে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, আপনি কাজ করে আনন্দিত হবেন, আপনার ইচ্ছা পূরণ হবে সেটিকেই প্রথমে রাখবেন৷ ক্যাডার চয়েজ সম্পূর্ণভাবে নিজের মত হওয়া চাই। এখানে কারো মত না নেয়াই শ্রেয়৷
যারা বিসিএস দিতে চান, তাদের প্রতি পরামর্শ কী থাকবে?
যারা বিসিএস দিতে চান আমি প্রথমেই বলব নিজেকে জানুন আগে। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এখানে নিজেকে ধরে রাখা, মনোযোগ বিঘ্ন না ঘটিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার মত কঠিন মানসিকতা প্রয়োজন। আমি ফেসবুক থেকে প্রায় ৪ বছর দূরে ছিলাম। আরেকটি আইডি খুলে শুধু বিসিএসভিত্তিক গ্রুপ গুলোতেই যুক্ত ছিলাম। এতে আমার ধ্যান-জ্ঞান শুধু বিসিএসকেন্দ্রিক ছিল। অন্য কোনো ঘটনা আমাকে প্রভাবিত করত না।
আরো পড়ুন: মায়ের স্বপ্ন পূরণে প্রথম বিসিএসেই প্রশাসন ক্যাডার ঢাবির নবমিতা
চাকরিপ্রার্থীদের বিসিএসকে একমাত্র লক্ষ্য বানানো কি ঠিক?
চাকরিপ্রার্থীদের জন্য আমার আরেকটি পরামর্শ হচ্ছে শুধু বিসিএস নিয়েই পড়ে না থাকা। অন্যান্য চাকরি পরীক্ষাতেও ভালো করা জরুরি। ৪৪তম বিসিএসে ভাইভা দিয়েছেন প্রায় ১১ হাজার ৭০০ পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে ক্যাডার হয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৬৯০ জন। তাই নিজেকে বিসিএসের গণ্ডিতে আটকে না রেখে সব চাকরি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা উচিত। আমি বর্তমানে জনতা ব্যাংক পিএলসিতে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছি। এর আগে ঢাকা সিটি কলেজে লেকচারার হিসেবে কাজ করেছি। ব্যাংক থেকে বাসায় ফিরে ২ ঘণ্টা ঘুমিয়ে সারারাত পড়তাম। ফজর নামাজ পড়ে ঘুমাতাম। যারা চাকরি করেন না তাদের অন্তত ৮ ঘন্টা পড়াশোনা করা উচিত। আর চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে সেটা ৪ ঘণ্টা হতে পারে।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই
আমি পুলিশকে দানবিক না-মানবিক হতে কাজ করতে চাই। কোনো দলবান্ধব নয় পুলিশ হবে জনবান্ধন। এটাই আমার মূলনীতি। এ নীতিকে ধারণ করে পুলিশিং সেবা দিতে আমি প্রস্তুত।
এমন কোনো ঘটনা যা এই পরীক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত যা আপনি বলতে চান
বিসিএসের যাত্রায় কঠোর পরিশ্রম যেমন দরকার তেমনি দরকার ভাগ্য। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তাকে বেশি বেশি স্মরণ করুন। নিয়মিত ইবাদত করুন। কাজের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকুন। সফলতা আসবেই।