পাহাড়ে সব জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় হোক ‘আমরা বাংলাদেশি’

কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া
কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া  © টিডিসি

বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, পালি অ্যান্ড বুুদ্ধিস্ট স্টাডিজের একজন গবেষক এবং বর্তমানে কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া। তিনি জাপানের আইচি গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বড়ুয়া জাপান সরকারের জেএসপিএস স্কলারশিপে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণাও সম্পন্ন করেন। ড. দিলীপ কুমারের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদান ও প্রবন্ধ উপস্থাপনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। 

উচ্চশিক্ষার নানা সংকট ও সম্ভাবনা, পাহাড়ে অস্থিরতা ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নানামুখী কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ হোসেন আসকালানী। 

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। সামনে কি কি চ্যালেঞ্জ দেখছেন?

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: আমি মূলত একজন শিক্ষক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একজন শিক্ষক হলেও তাকে প্রশাসকের কাজ করতে হয়। জাপানে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর শিক্ষকতা করে অভিজ্ঞতা লাভ করে আমি সমৃদ্ধ হলেও প্রশাসন চালানোয় বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যা ভূমি অধিগ্রহণ। তবে অধিগ্রহণের অনুমতি আমরা পেয়েছি এবং ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। এই জটিলতা দূর হলে অবকাঠামো নির্মাণের দিকে এগিয়ে যাব। ফলে আমরা আরও নতুন নতুন বিভাগ খুলতে পারবো।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশের সর্বাধিক হাওর অধ্যুষিত জেলার একটি হচ্ছে কিশোরগঞ্জ। এই বিশ্ববিদ্যালয় জেলার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কি ভূমিকা রাখবে? 

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: কিশোরগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় জেলার সমৃদ্ধি ও উন্নতিকল্পে নানা ধরনের গবেষণামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের গবেষণার ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য প্রজনন। এছাড়া হাওরকে কেন্দ্র করে কিশোরগঞ্জে পর্যটন ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করাও আমাদের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে হাওরের অর্থনীতিতে বিপ্লব হবে যা দেশকে ও আরও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন: ঢাকাকে বাসযোগ্য করে তুলতে বিকেন্দ্রীকরণ ও পরিকল্পিত নগরায়নের বিকল্প নেই: অধ্যাপক মঈনুল

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান বৃদ্ধি না করে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে। এ কারণে বাড়ছে উচ্চ শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা। এই সংকটের সমাধান কি?

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: আপনি জেনে থাকবেন বিবিএসের ২০২৪ সালের জরিপ অনুসারে, দেশে মোট বেকারের সাড়ে ১৩ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী। সুতরাং আমাদের গতানুগতিক শিক্ষা থেকে বের হয়ে এসে ব্যাবহারিক শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশ সমূহে কারিগরি পেশায় অভিজ্ঞ লোকদের বহু চাহিদা আছে। আমরা যদি যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনবলের দিকে নজর দিই তাহলে খুবই ভালো হবে। আমি জাপানে দক্ষ জনবলের বহু চাহিদা দেখেছি। বিশেষ করে তাদের নার্স ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক বেশি দরকার। এক্ষেত্রে জাপানি ভাষা শেখার কোনো বিকল্প নেই। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে-সব বিষয় চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবে অংশ নেয়ার মতো উপযোগী নয়, সেগুলোর সংখ্যা একদম কমিয়ে ফেলতে হবে। 

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: নতুন বাংলাদেশ পরবর্তী সময়ে অনেক সংস্কার কমিশন গঠন করা হলো। কিন্তু শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা হয়নি। এর কারণ কি?

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: শিক্ষা খাত বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে অবহেলিত। অথচ শিল্পায়নের এই যুগে মানসম্মত শিক্ষা অপরিহার্য। বাংলাদেশের জিডিপিতে (বিবিএস ২০২৪-২৫) শিল্পখাতের অবদান ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। আমাদের এই খাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে, সরকারের সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের যথাযথ যোগাযোগের অভাব আছে। দুভার্গ্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে কয়েক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি দেখে থাকবেন, একেকটার সিলেবাস একেক ধরনের। আমি মনে করি, শিক্ষা কমিশন অবশ্যই হতে হবে। শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে যুগোপযোগী শিক্ষার প্রচলন না করলে, বেকার সমস্যা সামাল দেয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। 

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি বহু বছর জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত আছেন। আপনি নিশ্চয় সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন। চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবে অংশ নেওয়ার জন্য আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা মানানসই বলে মনে করেন? 

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থায়, ছাত্র, শিক্ষক ও সরকারের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে। আমাদের এখানে না আছে ছাত্র-শিক্ষকদের সমন্বয়, না আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সরকারের। জাপানের সাথে আমাদের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু আমরা তো তাদের মডেলটা গ্রহণ করতে পারি। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। তাদের অভিজ্ঞতাও আমরা কাজে লাগাতে পারি। আমি মনে করি, তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণে জোর দেয়া উচিত। 

আরও পড়ুন: ইতিহাসের সত্য উঁকি দিয়েছে, এখন তা প্রকাশ্যে এসেছে: বদরুদ্দীন উমর

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি তো বৌদ্ধদের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ গুলো কি কি? 

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: আমি বহু বছর যাবত বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সাথে জড়িত আছি। সংগঠনটি ১৯৪৯ সালে গঠন করা হয়েছিলো। সংঘের তত্ত্বাবধানে ১৯৬০ সালে ঢাকার কমলাপুরে ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহার প্রতি‌ষ্ঠা করা হয়। ১৯৬২ সালে থাইল্যান্ডের ভূমিবল অতুল্যতেজ এবং রাণী সিরিকিত এই বিহারে এসেছিলেন। তাদের সংঘের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিলো। এই সংবর্ধনার মাধ্যমে থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যকার মৈত্রী সুদৃঢ় হয়েছে। পরবর্তীকালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ গড়ে তোলে নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধাহত ও অসহায় পরিবারের শিশুসন্তানদের জন্য গড়ে তোলা হয় ধর্মরাজিক অনাথালয়। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ধর্মরাজিক উচ্চ বিদ্যালয়, ধর্মরাজিক কারিগরি বিদ্যালয়, ধর্মরাজিক কিন্ডারগার্টেন, ধর্মরাজিক ললিতকলা একাডেমী , ধর্মরাজিক সাহিত্য আসর ও ধর্মরাজিক নিকিউনিয়ানো ক্লিনিক।

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে আপনার ভাবনার জায়গাটা আসলে কি এবং প্রায় সময় এই অঞ্চলে সৃষ্ট অস্থিরতাকে কীভাবে দেখেন?

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করছে। ভূমির মালিকানা নিয়ে জাতিগোষ্ঠীরগুলোর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। আমি নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, এটাই আমার আসল পরিচয়। তাই সব পক্ষের মেনে নেয়া উচিত, এটা আমাদের ভূমি এবং আমরা সবাই বাংলাদেশি। দেখুন, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরস্পরকে গ্রহণ করার মানসিক অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য থাকবেই, এটাই সৌন্দর্য। 

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: সেখানে বসবাসরত বৌদ্ধদের সমস্যা গুলো কী কী?

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: শিক্ষাকে আমি প্রধান প্রতিবন্ধকতা মনে করি। এটাকে সম্প্রসারিত করলে কুসংস্কার দূর হবে। পাহাড়ি জনপদ একটি দুর্গম অঞ্চল। দূরবর্তী অঞ্চলে শিক্ষা ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল। এই দুটো সমস্যাকে সমাধান করতে হবে। আমাদের প্রথম পরিচয়, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক- এই হোক আমাদের চেতনা। 

দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ। 

দিলীপ কুমার বড়ুয়া: আপনাকেও ধন্যবাদ। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদেরকে আমার শুভেচ্ছা।


সর্বশেষ সংবাদ