৫ প্রিলি, ৩ লিখিত ও ২ ভাইভার সবকটিতেই উত্তীর্ণ অ্যাডমিন ক্যাডার ইকবাল
- মামুন হোসাইন, ভোলা প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫, ১১:৩৫ AM , আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৫:৫৯ PM

৪৪তম বিসিএস-এ প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নিজের বহুদিনের আরাধ্য স্বপ্ন পূরণ করলেন ভোলার চরফ্যাশনের কৃতিসন্তান ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন সোহান। কঠোর পরিশ্রম, পরিবারিক অনুপ্রেরণা ও আত্মবিশ্বাসকে পাথেয় করে তিনি অর্জন করেছেন জীবনের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত সফলতা।
ইকবাল হোসেন, চরফ্যাশন পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আদর্শ পাড়ার বাসিন্দা। বাবা এ. কে. এম. আলাউদ্দিন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা, আর মা গৃহিণী।ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও সমান পারদর্শী ছিলেন ইকবাল। তার ছোট বেলা কেটেছে চরফ্যাশনেই। পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় ফ্যাশন সোসাইটি কিন্ডার গার্টেন ও চরফ্যাশন মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় উপজেলায় প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি।
পরবর্তী সময়ে বরিশাল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হয়ে অষ্টম শ্রেণিতে বোর্ড বৃত্তিতে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। এরপর বরিশাল মডেল স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও ঢাকা রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে থেকে এইচএসসি উভয় পরীক্ষাতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ অর্জন করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগে এবং ২০১৯ সালের জুলাই মাসে কৃতিত্বের সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডে (বিটিসিএল) সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন, বর্তমানে সেখানেই কর্মরত।
বিসিএস জার্নি
বিসিএস নিয়ে ইকবালের প্রস্তুতি শুরু হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে। প্রথম প্রিলিমিনারি ছিল ৪১তম বিসিএস। তবে তখন বিটিসিএলে যোগদানের কারণে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। এরপর তিনি টানা ৫টি প্রিলি, ৩টি লিখিত ও ২টি ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রতিবারই উত্তীর্ণ হন। তিনি বলেন, ‘বিসিএস যাত্রায় আমি সবগুলো ধাপে আল্লাহর রহমতে উত্তীর্ণ হতে পেরেছি।’
আরও পড়ুন: টানা ৫ প্রিলি ব্যর্থ, বন্ধুর অনুপ্রেরণায় শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম ঢাবি ছাত্র মোহাম্মদ উল্লাহ
প্রস্তুতির ধরন সম্পর্কে ইকবাল বলেন, ‘আমি সবসময় পড়াশোনাকে শর্ট ও ফলপ্রসূ রাখার চেষ্টা করেছি। বেশি পড়ার চেয়ে এনালাইসিসে গুরুত্ব দিয়েছি, কীভাবে কম পড়েও বেশি আউটপুট পাওয়া যায়, সেটিই ছিল লক্ষ্য।’
ভাইভা পরীক্ষার অভিজ্ঞতা ছিল নাটকীয়। ভাইবার ঠিক আগেই তার পায়ে অপারেশন হয়। ব্যথা নিয়েই অফিস ও প্রস্তুতি চালিয়ে যান। ভাইবার দিনও ব্যান্ডেজসহ পায়ে স্কচটেপ জড়িয়ে বোর্ডে প্রবেশ করেন। শেষ পর্যন্ত তার স্বপ্ন পূরণ হয়।
ক্যাডার চয়েজ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
প্রশাসন ক্যাডারকে সবসময় নিজের প্রথম পছন্দে রেখেছিলেন ইকবাল। তিনি বলেন, ‘সামাজিক মর্যাদা, কাজের বৈচিত্র্য এবং জনগণের সেবা করার সুযোগ, এই দিকগুলো মাথায় রেখেই চয়েজ দিয়েছি।’ ভবিষ্যতে দেশ ও জনগণের জন্য নিবেদিত থেকে কাজ করাই তার মূল লক্ষ্য।
বিসিএসকে একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে দেখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিসিএসে পরিশ্রমের পাশাপাশি ভাগ্যের বড় ভূমিকা রয়েছে। তাই বিকল্প পরিকল্পনা থাকা জরুরি। বিসিএসের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি চাকরির দিকেও মনোযোগী হওয়া উচিত।’
পরিবারের অনুপ্রেরণা
চার ভাই-বোনের মধ্যে ইকবাল দ্বিতীয়। তার বোনের স্বামী এবারই বিসিএসে আনসার ক্যাডারে পঞ্চম হয়েছেন, যা পরিবারে আনন্দের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। শৈশব স্মৃতি প্রসঙ্গে ইকবাল বলেন, ‘চরফ্যাশনের মাঠে খেলাধুলা করেই কেটেছে আমার ছেলেবেলা। দুষ্টুমিতে ভরা ছিল সেই সময়টা। কিন্তু স্বপ্ন ছিল সবসময় বড় কিছু করার।’
ইকবাল জানান, বিসিএস একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগিতা। সফলতার জন্য দরকার ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস এবং স্মার্ট স্টাডি। তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ টপিক নির্ধারণ করুন এবং নিয়মিত চর্চা করুন। আর সবচেয়ে বড় কথা, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখুন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিসিএস একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। এর পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতিও নেয়া উচিত, কারণ এখানে পরিশ্রমের পাশাপাশি ভাগ্যরও বড় ভূমিকা আছে।’ ভবিষ্যতে প্রশাসন ক্যাডারে থেকে দেশের জনগণের সেবা করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এই তরুণ প্রশাসক।
আমার ৪৫ বিসিএসে লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন প্রকাশ হয়, সেদিন আমার ৪৩ বিসিএস এডমিনের এক ফ্রেন্ড জিজ্ঞাসা করেছিলো যে, ৪৫ এর রিটেনে পাশ করেছি কিনা। তখন ওকে বলেছিলাম যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি এডমিনে সুপারিশপ্রাপ্ত হতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন রেজাল্টই আমাকে আনন্দ দিতে পারবে না। এডমিন ক্যাডার আমার কাছে এতটাই আরাধ্য ছিলো। তাই সফলতার অনুভূতি হচ্ছে বিসিএস নিয়ে আমার সব কল্পনা এখন সত্যি সত্যি অনুভব হচ্ছে। মনে হচ্ছে জীবনে আপাতত এর চেয়ে বড় সফলতা হয়তো আর কিছুই নেই। প্রত্যাশা পূরণের শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গিয়েছি আমি।
আরও পড়ুন: প্রস্তুতি শুরুর আগেই সবাই হেরে যায়, গড়ে ৪ ঘণ্টা পড়লেই বিসিএস ক্যাডার হওয়া সম্ভব
আমার শৈশবের ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত চরফ্যাশন উপজেলা পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডে কেটেছে। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি খুব ঝোক ছিলো। বাসার আশে পাশে কিংবা স্কুলে খেলাধুলার সুযোগ পেলেই খেলতাম। মোটামোটি চঞ্চল আর দুষ্টু স্বভাবেরই ছিলাম বলা যায়। এরপর ক্লাস সেভেন থেকে বরিশাল পড়াশুনার সুবাদে বরিশাল সদরেই থাকা হয়েছে এস এস সি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত।
আমি ৬ষ্ঠ ক্লাস পর্যন্ত চরফ্যাশন ফ্যাশন সোসাইটি কিন্ডার গার্টেন এবং চরফ্যাশন মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছি। ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষায় চরফ্যাশন উপজেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। এরপর ক্লাস সেভেন এ বরিশাল মডেল স্কুল ও কলেজে ভর্তি হই। বরিশাল মডেল স্কুল ও কলেজ থেকে অষ্টম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় বরিশাল বোর্ডে তৃতীয় স্থান অর্জন করি। এরপর বরিশাল মডেল স্কুল ও কলেজ থেকে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি সম্পন্ন করে একাদশ শ্রেণীতে ঢাকা রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে ভর্তি হই। এখান থেকেই গোল্ডেন জিপিএ-৫ নিয়ে এইচএসসি সম্পন্ন করি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক কৌশল বিভাগ থেকে ২০১৯ সালে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি সম্পন্ন করি। ২০২১ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানী লিমিটেড(বিটিসিএল) এ সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদান করি। বর্তমানে এখানেই কর্মরত আছি।
কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
প্রস্তুতির ব্যাপারে ইকবাল বলেন, আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। বিসিএস এর সার্কুলার যেহেতু প্রতি বছর নভেম্বরের দিকে আসে। তাই আমার প্রথম পরিকল্পনা ছিলো ২০১৯ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাকগ্রাউন্ডের যেসব জব রয়েছে সেগুলোর জন্য প্রস্তুতি নেয়া। এরপর বিসিএসের সার্কুলার দিলে বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতি শুরু করা। এবং এই প্লান অনুযায়ী এগিয়েছি। আমার প্রথম বিসিএস প্রিলি ছিলো ৪১ তম। ২০১৯ নভেম্বরে সার্কুলার দিয়েছিলো। মূলত ডিসেম্বরের পর থেকে আমি বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতি শুরু করি। এরপর মাঝে করোনার কারণে লম্বা সময় সব পরীক্ষা বন্ধ থাকায় প্রিলির জন্য মোটামোটি প্রস্তুতির সুযোগ পাই। তবে একই সাথে আমার ডিপার্টমেন্টাল জবের প্রস্তুতিও চালাতে হয়েছে। এরপর ৪১ প্রিলি পাশের ২/৩ মাসের মধ্যেই বিটিসিএল এ যোগদান করার কারণে ৪১ লিখিত এর প্রস্তুতি নিতে পারিনি এবং বিটিসিএল এর ফাউন্ডেশন ট্রেনিং এ থাকায় ৪১ এর লিখিততে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। এরপরের প্রিলি, লিখিতগুলো চাকরীর পাশাপাশি যতটুকু পেরেছি প্রস্তুতি নিয়েছি। তবে একটা মজার বিষয় হচ্ছে বিসিএস জার্নিতে আমি ৫ প্রিলি, ৩ লিখিত ও ২ ভাইভাতে অংশগ্রহণ করে সবগুলোতেই পাস করেছি আল্লাহর রহমতে। আমাকে যেহেতু জেনারেল এবং ডিপার্টমেন্টাল দুই দিকেই প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। তাই আমি সবসময় চেষ্টা করেছি, পড়াশুনাকে যতটা শর্ট করা যায়। এর জন্য আমি বেশি পড়ার চেয়ে এনালাইসিস করায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এনালাইসিস করে খুব স্বল্প পড়ায় বেশি আউটপুট কিভাবে আনা যায় সেটি চেষ্টা করেছি।
আরও পড়ুন: শুরুর দুই বিসিএসে প্রিলি ফেল, তৃতীয় বারের চেষ্টায় বাজিমাত ঢাবি ছাত্র পাভেলের
পরিবারে আমার বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা এবং মা গৃহিনী। আমরা চার ভাই বোন। মজার বিষয় হচ্ছে, আমার এক বোনের স্বামীও এবার বিসিএস আনসার ক্যাডারে পঞ্চম হয়েছে। প্রশাসন, পুলিশ, ট্যাক্স, অডিট, বাণিজ্য ক্যাডার চয়েজের ক্ষেত্রে আমি মূলত সামাজিক মর্যাদা, কাজের ক্ষেত্রে বৈচিত্রতা, জনগণের সেবা করার সুযোগ এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছি।
বিসিএস প্রত্যাশীদের প্রতি পরামর্শ
বিসিএস প্রত্যাশীদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে ইকবাল বলেন, বিসিএস একটি লম্বা দৌড় প্রতিযোগীতা। এখানে ধৈর্য্য হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানী। এর সাথে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস, প্রশ্ন এনালাইসিস করে টপিকের গুরুত্ব বুঝে পড়াশুনা করা এবং একই সাথে পরীক্ষায় সর্বোচ্চ আউটপুট দেয়াটাই আসল বিষয়। বিসিএস এ পরিশ্রমের সাথে সাথে ভাগ্যের একটা বিশাল অবদান আছে। আল্লাহ তাকদীরে না রাখলে শত চেষ্টা করেও আসলে অনেকের রিজিকে বিসিএস থাকে না। এছাড়া যেহেতু বিসিএস সময় সাপেক্ষ ব্যাপার তাই অবশ্যই এর পাশাপাশি অন্যান্য ভালো ভালো সরকারি চাকরীর প্রস্তুতি নেয়া উচিত।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
প্রশাসন ক্যাডার আমার স্বপ্ন ছিল। বিসিএস এর স্বপ্ন দেখার শুরু থেকেই আমি জনগণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে দেশের স্বার্থে কাজ করে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে এসেছি। তাই ভবিষ্যতে দেশের জন্য নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করবো।
৪৪তম বিসিএস এর ভাইভার তারিখ হুট করেই পড়ে আমার। দ্বিতীয়বার যখন ভাইবার শিডিউল দেয় তখন প্রথমেই বোথ ক্যাডারের ভাইবার শিডিউল দেয়ায় মাত্র ১৫/১৬ দিন আগে আমি জানতে পারি আমার ভাইবার তারিখ। এবং ওই সময় আমার পায়ে একটি অপারেশন হয়। ফলে অপারেশনের ব্যাথা নিয়েই অফিস করা এবং অল্প অল্প ভাইভার প্রস্তুতি নেই। এবং ভাইভার দিনও আমার পায়ে ব্যান্ডেজ থাকা অবস্থায় স্কচটেপ পেচিয়ে ভাইভা বোর্ডে প্রবেশ করি, যাতে ব্যান্ডেজ খুলে না যায়। অবশেষে, আল্লাহ সফলতার মুখ দেখিয়েছেন।