ইউএনও'র স্বাক্ষর জালিয়াতি করে মাউশি কর্মকর্তার মেয়েকে নিয়োগের অভিযোগ

মাউশি রংপুর অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মোঃ আমীর আলী
মাউশি রংপুর অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মোঃ আমীর আলী  © সংগৃহীত ছবি

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে নিজের মেয়েকে নিয়োগ দিয়ে অবৈধভাবে বেতন ভাতা উত্তোলন করার অভিযোগ উঠেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) রংপুর অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মোঃ আমীর আলীর বিরুদ্ধে। ইউএনও এর স্বাক্ষর জালিয়াতি ও অবৈধ নিয়োগের বিষয়ে মাউশিকে কয়েক দফা প্রতিবেদন ও অবহিতকরণ করার পরেও অক্টোবর মাস থেকে মাউশি কর্মকর্তার মেয়েসহ অবৈধ নিয়োগের ১৩ জনের বেতন ভাতা চালু হওয়ায় অস্বস্তিতে পড়েছেন উপজেলার ইউএনও। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ শামীম মিঞা বিষয়টি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে নিশ্চিত করেছেন।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল অবস্থার মধ্যে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা মডেল কলেজে ল্যাব সহকারী (রসায়ন) পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৮ আগস্ট একজনকে নিয়োগও দেওয়া হয়। সেই পরীক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (ডিজি) প্রতিনিধি হিসেবে যার সই রয়েছে, সেটি জাল বলে অভিযোগ রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সইও জাল। এ ছাড়া ইনডেক্সের বিনিময়ে মাউশি কর্মকর্তার মেয়ে, ভাতিজা ও শ্যালিকাকে নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে। এসব কিছুই হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) রংপুর অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মোঃ আমীর আলীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়।

মাউশি কর্মকর্তা মেয়ের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন

কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৪ আগস্ট কলেজে ল্যাব সহকারী (রসায়ন) পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন সুজিত কুমার, মো. হাফিজুল ইসলাম ও আয়েশা সিদ্দিকা। সর্বোচ্চ নম্বরে আয়েশা সিদ্দিকা নির্বাচিত হন। ফলাফলের কাগজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাছেন আলী, বিষয় বিশেষজ্ঞ লালমনিরহাট মজিদা খাতুন সরকারি মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রভাষক বিমল চন্দ্র বর্মণ, মাউশির ডিজি প্রতিনিধি লালমনিরহাট মজিদা খাতুন সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক নজরুল ইসলাম, কলেজের দাতা সদস্য তছলিম উদ্দিন ও কলেজ সভাপতি ইউনুছ আলীর সই রয়েছে। এর চার দিন পর কলেজটিতে আয়েশা সিদ্দিকার নিয়োগ চূড়ান্ত হয়। ইনডেক্স তালিকায় মাউশি কর্মকর্তার মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামের পাশে ইউনুছ আলীর মোবাইল নম্বর ব্যবহার ও ইনডেক্স আবেদনে ইউএনওর সই জাল করা।

এ বিষয়ে ওই কলেজের প্রভাষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ২০২৪ সালের জুনে অবসর নিয়েছি। ২০১৬ সালের পর হাতীবান্ধায় যাইনি। ৪ আগস্ট তো যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমার সই জাল করেছে।’ দাতা সদস্য তছলিম উদ্দিন বলেন, ‘আমাকে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সই নিয়েছে। কোথায় নিয়েছে, বলতে পারব না।’ নিয়োগ পাওয়া আয়েশা সিদ্দিকা মাউশি রংপুর অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক আমির আলীর মেয়ে। আর কলেজের বিজ্ঞান ল্যাবে সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া শাহিন আলম পরিচালক আমির আলীর ভাতিজা। সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে নিয়োগ পাওয়া সাজেদা পারভীন মাউশি ঢাকা অফিসের কর্মকর্তা বসির উদ্দীনের শ্যালিকা। প্রথম ধাপে ১৩ জন এমপিওভুক্তির ইনডেক্স তালিকায় রয়েছেন আয়েশা ও শাহিন। এ বিষয়ে সাবেক প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ইউনুছ আলী বলেন, ‘মাউশি পরিচালক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁর মেয়ে ও ভাতিজাকে নিলে টাকা ছাড়া কলেজের ইনডেক্স করে দেবেন।’

কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাছেন আলী হাতীবান্ধা উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির। জামায়াতের জেলা নায়েবে আমির হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কলেজ নিয়ে ইউএনও এর স্বাক্ষর জালিয়াতি করে বিতর্কিত হওয়ায় হাছেন আলীকে ইতিমধ্যেই দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে রোববার দুপুর ৩ টায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর রংপুর অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মোঃ আমীর আলীর অফিসে গেলে জানা যায়,অফিসের জন্য সরকার নির্ধারিত সময়ের ২ ঘন্টা পূর্বেই তিনি বাসায় চলে গেছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রতিবেদককে বলেন,হাতীবান্ধা মডেল কলেজের বিষয়ে অভিযোগ,ফাইল আমি শুনানিতে দিয়েছি। নিজের মেয়ে,ভাতিজা ও ঢাকা অফিসের কর্মকর্তার শ্যালিকাকে ইনডেক্সের বিনিময়ে অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করতেই মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এই কর্মকর্তা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে হাতীবান্ধা মডেল কলেজ সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম মিঞা বলেন, আমার সই স্ক্যান করে ১৩ জনের ইনডেক্স করেছে। এটা জালিয়াতি। এই কলেজের অধিকাংশ নিয়োগ হয়েছে অর্থের বিনিময়ে। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সভাপতি ইউনুস আলী বিভিন্ন সময়ে মোটা অংকের টাকা নিয়ে এক পদে একাধিক লোককে নিয়োগ দিয়েছে। ইনডেক্স দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই কলেজে মাউশি কর্মকর্তা নিজের মেয়েকে নিয়োগ দিয়েছে বলে জেনেছি। স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ১১ জনের ইনডেক্স পাঠানো ও মাউশি কর্মকর্তার মেয়ের অবৈধ নিয়োগের বিষয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে জানানোর পরেও ২ মাস থেকে তারা কিভাবে বেতন পাচ্ছে আমার জানা নেই। ৮ মাস পূর্বেও মাউশি থেকে অবৈধ নিয়োগ গুলোর বিষয়ে তদন্ত হয়েছে। অবৈধ নিয়োগ প্রাপ্তদের বেতন হওয়ার পরে পুনরায় ডিসি স্যারের মাধ্যমে মাউশিতে লিখিত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রভাব খাটিয়ে সবকিছু আটকিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই কলেজে পড়াশোনার কোন পরিবেশ নেই। এই কলেজটি নিয়ে আমি নিজেও বিব্রত।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের বেসরকারি কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক মোঃ মাঈন উদ্দিন জানান,হাতীবান্ধা মডেল কলেজে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ১১ জনের ইনডেক্স পাঠানোর অভিযোগ পেয়েছি। এটার নথি চলমান। এটার বেতন হবে না। গত ২ মাস পূর্ব থেকে তাহলে বেতন কিভাবে পাচ্ছে প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বেতন হওয়ার আগে আমাদের কাছে তো অভিযোগ আসতে হবে। বেতন হলেও সমস্যা নেই। স্বাক্ষর জালিয়াতি প্রমাণ হলে ইনডেক্স বাতিল করা হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ অধিদপ্তরের রংপুর পরিচালক আমীর আলী ইনডেক্সের বিনিময়ে নিজের মেয়ে,ভাতিজা,শ্যালিকাকে নিয়োগ দিয়েছে ও তার বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ উঠেছে, এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন অভিযোগগুলো নথিভুক্ত করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


সর্বশেষ সংবাদ