বিনষ্টের ঝুঁকিতে আলিয়া মাদ্রাসা গ্রন্থাগারের আড়াইশ বছরের দুষ্প্রাপ্য বই
- নবাব আব্দুর রহিম
- প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:২৩ PM , আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩১ PM
কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে থরে থরে সাজানো বই। তবে আকার দেখে খুব একটা সাধারণ মনে হয় না। বর্তমানে ছাপা বইয়ের তুলনায় বেশ বড় আকারের, পাতাগুলোও তেমন মোটা। যদিও হাতে ধরলে মনে হবে পাতা ছিঁড়ে পড়ে যাবে এখনই। এই ভবনটির দেয়ালে নির্মাণকাল লেখা খ্রিষ্টীয় ১৯৬০, তবে গ্রন্থাগারটির বয়স এত অল্প নয়—আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে স্থাপিত হয়েছে এ সংগ্রহশালাটি (লাইব্রেরি)। সংগ্রহে আছে দেশের অন্যতম দুষ্প্রাপ্য সব গ্রন্থ। সচিত্র শাহনামার দুর্লভ কপি থেকে হাতে লেখা পবিত্র বুখারি শরীফও আছে এখানে।
বলছিলাম ঢাকার সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটির (লাইব্রেরি) কথা। স্বাধীন নবাবদের পতনের পর নতুন রাজধানী কোলকাতায় আরবি-ফারসি ও উর্দু শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ১৭৮০ সালে স্থাপিত হয় কলকাতা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা। এরই একটি অংশ উত্তরাধিকার সূত্রে ১৯৪৭ সালে অর্জন করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। সঙ্গে চলে আসে দুর্লভ আর অমূল্য এক রত্নভাণ্ডার—কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি। একাডেমিক লাইব্রেরি হিসেবে এটি দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারগুলোর একটি। আছে সাড়ে ২৪ হাজার বই, প্রায় প্রতিটিই কোনো না কোনো সময়ে ছিল সিলেবাসে। সহজেই অনুমেয় যুগের আবর্তে জৌলুস হারাতে বসা প্রতিষ্ঠানটির পাঠ্যক্রম এক সময়ে কতটা সমৃদ্ধ ছিল।
মাদ্রাসা গ্রন্থাগারটি ঘুরে দেখা গেছে, বেশ বড় একটি কক্ষের চার পাশ ঘিরে সাজানো রয়েছে অনেক বুকশেলফ। মাঝে আরও দুটি সারি। প্রতিটি শেলফে থরে থরে সাজানো বইয়ের সমাহার। গ্রন্থগুলোর ভাষা দেখে মনে হয় আরবিতে লেখা। পরক্ষণে টের পাওয়া যায় সবগুলো আরবি নয়। জানা গেল, আরবির পাশাপাশি ফারসি এবং উর্দু ভাষার দুষ্প্রাপ্য বহু গ্রন্থ রয়েছে এখানে। কোনো কোনোটা আবার হাতেও লেখা। আছে পাণ্ডুলিপিও।
আরও পড়ুন: নিজে পঞ্চম শ্রেণি পেরোতে পারেনি, জেদ থেকে অন্যদের জন্য লাইব্রেরি গড়লেন দিনমজুর জয়নাল
গ্রন্থাগারটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার লাইব্রেরিয়ান মাহমুদা বেগম। তিনি তুলে ধরলেন গ্রন্থাগারটির ইতিহাস, জানালেন কত অমূল্য সব সম্পদে ঠাঁসা এই গ্রন্থাগার। দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে মাহমুদা বেগম বলেন, ‘প্রতিষ্ঠাকাল অর্থাৎ ১৭৮০ সাল থেকে শুরু করে এই সময়কার কিতাবও এই লাইব্রেরিতে রয়েছে। এর মধ্যে আমরা যেটিকে সবচেয়ে মূল্যবান মনে করি, সেটা ফেরদৌসির শাহনামা। এটা আমাদের এখানেই আছে, বাংলাদেশের অন্য কোথাও নেই। ফারসি কিছু গ্রন্থ আছে, যা হাতে লেখা। হাতে লেখা বুখারী শরীফও আছে। এ ছাড়া কিছু পাণ্ডুলিপি এবং প্রাচীন ইসলামী বিশ্বকোষ থেকে শুরু করে দুর্লভ বই ও এনসাইক্লোপিডিয়া আছে এখানে।’
দুর্লভ আর দুষ্প্রাপ্য এসব গ্রন্থ সংরক্ষণের তেমন সুযোগ-সুবিধা এবং উপকরণ নেই গ্রন্থাগারটিতে। লাইব্রেরিয়ান এবং মাদ্রাসার অধ্যক্ষ- উভয়ের কণ্ঠেই এই অসহায়ত্ব স্পষ্ট। রক্ষণাবেক্ষণ হয় একেবারে সনাতন পদ্ধতিতে।
তিনি বলেন, ‘ন্যাশনাল লাইব্রেরির (জাতীয় গ্রন্থাগার) সাথে আর্কাইভ সেন্টার থাকে, সেখানে অন্তত ২৫ বছরের পুরনো এবং ভবিষ্যমূল্য আছে এমন গ্রন্থগুলো সংরক্ষণ করা হয়। ফলে ন্যাশনাল লাইব্রেরি এবং আর্কাইভ যেটা, সেখানে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই থাকবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু একাডেমিক লাইব্রেরি হিসেবে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রন্থাগার হিসেবে এরকম ‘রেয়ার বুক’ বা অনেক সময়ের পুরাতন বই সাধারণত থাকে না। এটা আলিয়া মাদ্রাসা লাইব্রেরিতে আছে।’
আরও পড়ুন: বাংলা লিপি বিবর্তনের একাল ও সেকাল
ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এন্ট্রি করে পাশের পাঠকক্ষে গ্রন্থগুলো অধ্যয়নের সুযোগ পান। গ্রন্থাগারটির পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগেই সেমিনার লাইব্রেরিও রয়েছে। বর্তমান পাঠ্যক্রম এবং এর উপযোগী রেফারেন্স গ্রন্থ সেমিনার লাইব্রেরিতে সহজলভ্য হওয়ায় খুব একটা এ গ্রন্থাগারে আসার প্রয়োজন পড়ে না তাদের। তদুপরি, মঙ্গলবার মাদ্রাসায় বিভিন্ন শ্রেণির পরীক্ষা চলায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো ছায়া দেখা গেল না। ষষ্ঠ শ্রেণির কিছু শিক্ষার্থীকে দেখা গেল গ্রন্থাগারটিতে লুকোচুরি খেলতে। তবে লাইব্রেরিয়ান জানালেন, শুধু মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীই নন, দেশ এবং দেশের বাইরের গবেষকরা এখানে ছুটে আসেন দুর্লভ সব গ্রন্থের খোঁজে।
গ্রন্থগুলোর ভাষা দেখে মনে হয় আরবিতে লেখা। পরক্ষণে টের পাওয়া যায় সবগুলো আরবি নয়। জানা গেল, আরবির পাশাপাশি ফারসি এবং উর্দু ভাষার দুষ্প্রাপ্য বহু গ্রন্থ রয়েছে এখানে। কোনো কোনোটা আবার হাতেও লেখা। আছে পাণ্ডুলিপিও।
মাহমুদা বেগম বলেন, ‘কিছু কিছু কিতাব আছে—যেগুলোর জন্য অনেক বিদেশি পাঠক আসছেন, বিদেশি গবেষক আসছেন। তবে তারা একটা স্পেসিফিক চাহিদা নিয়ে আসেন। জানেন যে এখানে ওই জিনিসটা আছে, স্পেসিফিক সে বইয়ের জন্য আসেন। আমি ধারণা করি, তারা সম্ভবত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসাতে যান, ওখান থেকে একটা ধারণা নিয়ে আসেন এই এই কিতাবগুলো ঢাকা আলিয়াতে আছে। তারা এখানে এসে বইগুলো খুঁজে বের করেন। মূলত উর্দু বা আরবির তুলনায় ফারসি কিতাবের জন্য বেশি গবেষক পাওয়া যায়। বিশেষ করে তেহারান দূতাবাস থেকে যারা আসেন, তারা শুধু ফারসি কিতাবের জন্য আসেন। দেখা যায় টানা ১০-১৫ দিন তারা কাজ করেন।’
তবে দুর্লভ আর দুষ্প্রাপ্য এসব গ্রন্থ সংরক্ষণের তেমন সুযোগ-সুবিধা এবং উপকরণ নেই গ্রন্থাগারটিতে। লাইব্রেরিয়ান এবং মাদ্রাসার অধ্যক্ষ- উভয়ের কণ্ঠেই এই অসহায়ত্ব স্পষ্ট। রক্ষণাবেক্ষণ হয় একেবারে সনাতন পদ্ধতিতে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে লাইব্রেরিয়ান মাহমুদা বেগম বলেন, ‘যে কোনো কিছু পুরনো হলে ছিড়বেই। আর এগুলো ২০০-২৫০ বছরের পুরনো কাগজ। সংরক্ষণের জন্য আমরা কিছু রাসায়নিক ব্যবহার করি।’
বর্তমান গ্রন্থাগারটি দুর্লভ বইগুলো রক্ষণাবেক্ষণের উপযুক্ত নয়। এজন্য আমরা বারবার আবেদন করেছি যেন লাইব্রেরিটি আধুনিকায়ন করা যায়—অধ্যাপক মোহাম্মদ উবাইদুল হক, অধ্যক্ষ।
তবে এটি কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত তা বলতে পারলেন না তিনি। বললেন, ‘বইয়ের মধ্যে এক ধরনের পোকার জন্ম হয়, এই পোকা যেন ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য অভিজ্ঞ লোক দিয়ে এই রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া আমাদের কাজ হচ্ছে মুছে মুছে পরিষ্কার রাখা। যেন ধুলাবালি কম হয়। তবে সমস্যা হচ্ছে গ্রন্থাগারটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত না হওয়ায় যত্রতত্র ধুলাবালি প্রবেশ করে। একই সাথে প্রতিদিন বইয়ের আলমারি খুলে দেওয়া হয় যেন ভিতরে বাতাস যায়।’
এত কিছুর পরেও দুর্লভ গ্রন্থগুলো সংরক্ষণ সম্ভব নয়। বর্তমানে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের আগ্রহ অত্যাধুনিক গ্রন্থাগার ভবন নির্মাণ। এ ছাড়া বিশেষ করে দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থগুলো সংরক্ষণে ই-বুক প্রস্তুত করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব গিয়েছে বলেও জানাচ্ছেন তারা।
আরও পড়ুন: আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের কামিল পরীক্ষার ফলে দেশসেরা ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা
জানতে চাইলে সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়ার অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ উবাইদুল হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমাদের লাইব্রেরিটিতে দেশ-বিদেশের গবেষকরা ছুটে আসেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও উৎসাহিত করি এটি ব্যবহারের জন্য। তবে বর্তমান গ্রন্থাগারটি দুর্লভ বইগুলো রক্ষণাবেক্ষণের উপযুক্ত নয়। এজন্য আমরা বারবার আবেদন করেছি যেন লাইব্রেরিটি আধুনিকায়ন করা যায়। স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার ভবন নির্মাণের ইচ্ছা আছে। একই সাথে ই-লাইব্রেরি করা, যেন রক্ষণাবেক্ষণের অনুপযুক্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা গ্রন্থগুলো ইলেকট্রনিক ফরম্যাটে সংরক্ষণ করা যায়।’