বাংলা লিপি বিবর্তনের একাল ও সেকাল

বাংলা লিপি বিবর্তন
বাংলা লিপি বিবর্তন  © সংগৃহীত

লেখা, যা মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম প্রকাশব্যবস্থা ও ভাব প্রকাশের এক শক্তিশালী মাধ্যম, আজকের দিনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রবেশ করেছে। যখন আমরা স্মার্টফোনে বাংলা লেখার কথা বলি, তখন হয়তো এক মুহূর্তের জন্যও ভাবি না, এই বাংলা লিপির ইতিহাস কত প্রাচীন, কত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এটি আজকের অবস্থানে এসেছে। বাংলা লিপির ইতিহাস মূলত একটি ধারাবাহিক বিবর্তনের গল্প—যা গুহাচিত্র থেকে ছাপাখানা, এবং সেখান থেকে ডিজিটাল স্ক্রিন পর্যন্ত বিস্তৃত। এই প্রবন্ধে আমরা সেই বিবর্তনের ধারা অনুসরণ করব।

মানুষ যখন ভাব প্রকাশের জন্য ছবি আঁকতে শুরু করল, তখন সেটিই ছিল ভাষার প্রাথমিক রূপ। সুমেরীয় সভ্যতা (খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০–৩০০০) পৃথিবীর প্রথম সভ্যতা, যেখানে কিউনিফর্ম নামে এক ধরনের লিখনপ্রণালী ব্যবহৃত হতো। এটি ছিল চিহ্নভিত্তিক এবং ব্যবহৃত হতো বাণিজ্য, ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কাজে। পরে মিশরীয় সভ্যতায় (খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০) হায়ারোগ্লিফিক পদ্ধতির উদ্ভব হয়—এটি ছিল চিত্র ও চিহ্নের সমন্বয়, যা রাজকীয় বা ধর্মীয় বার্তা ধারণ করত।

এরপর, ফিনিশীয়রা খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের দিকে বর্ণমালার ধারণা দেয়। এটি ছিল প্রতীকভিত্তিক হলেও পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ অক্ষরভিত্তিক লিখনপ্রণালী হিসেবে বিকশিত হয় এবং গ্রিক ও রোমান সভ্যতায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

বাংলা লিপির ইতিহাসে ব্রাহ্মী লিপির উদ্ভব এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে এই ব্রাহ্মী লিপি ব্যবহৃত হয়। এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম অক্ষরভিত্তিক লিখনপ্রণালী। পরবর্তীতে ব্রাহ্মী লিপি থেকে গৌড়ীয় লিপির জন্ম হয়, যা বাংলা, অসমিয়া ও ওড়িয়া লিপির পূর্বসূরি।

গৌড়ীয় লিপি ছিল বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ। প্রাক-বাংলা বা গৌড়ীয় লিপির সময়কাল ছিল খ্রিস্টীয় ৫ম থেকে ১০ম শতাব্দী। এই লিপির বিকাশ থেকেই বাংলা লিপি নিজের স্বতন্ত্র রূপ লাভ করে।

বাংলা ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্যকীর্তি হলো চর্যাপদ, যা ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়। এটি অবহট্‌ঠ ভাষায় রচিত বৌদ্ধ সাধকদের আধ্যাত্মিক কাব্য, যেখানে জীবনের নানা দিক মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটে উঠেছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদের পাণ্ডুলিপিগুলো আবিষ্কার করেন। এই কাব্য বাংলা ভাষা ও লিপির বিকাশের এক প্রামাণ্য দলিল।

পাল ও সেন আমলে বাংলা সাহিত্য চর্চা বিকশিত হয়। মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলি এবং নানা ধর্মীয় কাব্য তখন হাতে লেখা হতো কাগজ, তালপাতা বা তাম্রফলকে। মুসলিম শাসনামলে কাগজের ব্যবহার বৃদ্ধি পায় এবং ছাপাখানার প্রচলন শুরু হয়। এতে করে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়।

১৮শ শতকের শেষভাগে ইউরোপীয় ছাপাখানার আগমন বাংলা ভাষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নাথানিয়েল ব্রাসি হালহেড বাংলার প্রথম ব্যাকরণ গ্রন্থ A Grammar of Bengal Language রচনা করেন। কিন্তু বাংলা লিপির কাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে। তাঁর বর্ণপরিচয় গ্রন্থ বাংলা লিপিকে সহজ, নিয়মমাফিক ও শিক্ষার্থীবান্ধব করে তোলে।

বর্তমানে ইউনিকোড প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলা লিপি ডিজিটাল মাধ্যমে সহজে ব্যবহারযোগ্য হয়েছে। এখন স্মার্টফোন, কম্পিউটার বা ট্যাবলেটে বাংলা লেখা যায় দ্রুত ও শুদ্ধভাবে। প্রযুক্তির কল্যাণে বাংলা লিপি পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বজুড়ে পাঠকের কাছে।

ডিজিটাল যুগে লেখার মাধ্যম বদলালেও বাংলা লিপির আত্মা রয়ে গেছে একই। গুহাচিত্রের ভাব থেকে শুরু করে ডিজিটাল স্ক্রিনে টাইপ করা পর্যন্ত—এই লিপি আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে বহন করে চলেছে।

বাংলা লিপির বিবর্তন কেবল একটি ভাষার রূপান্তরের গল্প নয়; এটি একটি জাতির বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রামাণ্য দলিল। ব্রাহ্মী থেকে গৌড়ীয়, চর্যাপদ থেকে বিদ্যাসাগর—এই পথচলায় বাংলা লিপি তার ঐতিহ্যকে ধারণ করে নতুন যুগে এগিয়ে চলেছে।


সর্বশেষ সংবাদ