নিজে পঞ্চম শ্রেণি পেরোতে পারেনি, জেদ থেকে অন্যদের জন্য লাইব্রেরি গড়লেন দিনমজুর জয়নাল
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ০১:২৯ PM , আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০২৫, ০২:১৮ PM
কুড়িগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম সাতভিটা। গ্রামের মেঠোপথ ধরে এগোলে চোখে পড়ে একটি আধাপাকা ঘর হালকা নীল রঙের দেয়াল, সামনের দিকে লোহার গ্রিল, ঝকঝকে মেঝে। ঘরের ভেতরে একটি বড় টেবিল, পাশে চেয়ার আর বেঞ্চ। দুই পাশে কাঠের আলমারিতে থরে থরে সাজানো প্রায় সাড়ে তিন হাজার বই। মনোযোগে ডুবে আছেন কয়েকজন পাঠক। দেয়ালে টানানো ছবি—রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হকের। এই বইঘরের নাম—‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়’।
এই গ্রন্থনীড়ের কারিগর হচ্ছেন জয়নাল আবেদীন। পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে না পারা এক দিনমজুর। জন্মেছেন দরিদ্র কৃষক পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করতেন। পরে শুরু করেন দিনমজুরি। অথচ আর পাঁচজন সাধারণ দিনমজুরের মতো জীবন থেমে থাকেনি তার। বইয়ের প্রেমে, স্বপ্নের টানে নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন একটি পাঠাগার।
বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কাজ না থাকলে জয়নাল পাড়ি দিতেন গাজীপুরে। একবার গিয়েই ইটভাটায় কাজ পেয়ে যান। কাজ শুরু হতো গভীর রাতে, শেষ ভোরে। দিনে সময় থাকত। দুপুরে খেয়ে আড্ডা দিতেন বাজারে, কখনো টিভি দেখতেন চায়ের দোকানে।
.jpg)
২০১১ সালের একদিন ইটভাটার কাজ শেষে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ একটি ফুটপাথের বইয়ের দোকানে চোখ আটকে যায়। নাম ভালো লাগে, দামও হাতের নাগালে। কিনে নেন দুটি বই। পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করেন—এই বইগুলো এক অন্য আনন্দ দেয়। তারপর থেকে নিয়মিত বই কেনা শুরু করেন।
গাজীপুরে থাকাকালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, টঙ্গী রেলস্টেশন, টঙ্গী কলেজ গেটের পুরনো বইয়ের দোকানগুলো তার কাছে হয়ে ওঠে রত্নভাণ্ডার। সংগ্রহ বাড়তেই থাকে। বইয়ের প্রতি এই ভালোবাসা তাকে ভাবায় গ্রামে ফিরে একটা পাঠাগার করবেন। যেন অন্যরাও বই পড়তে পারে। আবার মনে হতো ‘আমি দিনমজুর, লোকজন কি হাসবে না?’ নিজেকেই সাহস দিতেন—‘যে যা বলুক, আমি পাঠাগার গড়বই।’
পরে বাড়ি ফিরে কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করেন। সবাই রাজি হয়ে যান। গ্রামে একটি পরিত্যক্ত জায়গায় টিনের চালা তুলে তৈরি হয় একটি ছোট পাঠাগার। বানান একটি র্যাক, কয়েকটি চেয়ার ও টেবিল। পাঠাগারের নাম দেন—‘সাতভিটা গণপাঠাগার’। উদ্বোধন হয় ২০১১ সালের ১৫ নভেম্বর। ২০১৩ সালে পাঠাগারে বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০০। গ্রামবাসী, শিক্ষার্থীরা নিয়মিত আসেন। কিন্তু সে বছর নির্বাচনী সহিংসতায় সাতভিটা গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। এক জন নিহত হন। পাঠাগারও বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে জয়নাল র্যাকসহ সব বই তুলে দেন অন্য একটি পাঠাগারে।
তিনি ফের যান গাজীপুরে, তবে মন পড়ে থাকে বইয়ের পাতায়। ফিরে এসে নিজের ঘরের এক পাশে ফের বই সংগ্রহ শুরু করেন। বাড়ি বাড়ি বই পৌঁছে দেন। আবার নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে সেগুলো ফেরত আনেন।
২০১৫ সালে জয়নাল এক প্রতিবেশীর কাছে পাঠাগারের জন্য এক শতাংশ জমি চান। প্রতিবেশী দাম ধরেন ২০ হাজার টাকা। ঠিক হয়, প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে দেবেন জয়নাল। সেই চুক্তিতেই জমি কেনেন তিনি। খবর ছড়িয়ে পড়তেই কেউ বলেন ‘পাগলামি’, কেউ কটাক্ষ করেন ‘গরিবের ঘোড়ারোগ’। জয়নাল বলেন, ‘মন খারাপ হলেও থেমে থাকিনি। বরং এক ধরনের জেদ কাজ করত।’
২০১৯ সালে জমির পুরো দাম শোধ করে ফেলেন। বন্ধু আর পাঠকদের সঙ্গে নিয়ে জমি ভরাট করেন। তোলা হয় একটি টিনের চালা, বানানো হয় বুকশেলফ, চেয়ার, টেবিল। অবশেষে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নতুন পাঠাগারের উদ্বোধন হয়—‘সাতভিটা গ্রন্থনীড়’। এই প্রচেষ্টা নজরে আসে সরকারের যুগ্ম সচিব এনামুল হাবীবের। বর্তমানে এলজিএসপি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। একদিন গ্রন্থনীড় দেখতে এসে পাঠকসংখ্যা ও জয়নালের চেষ্টা দেখে অভিভূত হন। সেদিনই প্রতিশ্রুতি দেন—ঘরটি পাকা করে দেবেন।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি হয় আধাপাকা ঘর, প্রয়োজনীয় আসবাব, নতুন কিছু বই। ৬ অক্টোবর ঘরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এখন প্রতিদিন এখানে বই পড়েন ২৫ থেকে ৩০ জন, আর মাসে বই নিয়ে যান প্রায় ৫৫০ থেকে ৬০০ জন পাঠক।
এখন আর গাজীপুরে কাজ করতে যান না জয়নাল। থাকেন গ্রামেই। আয় কমেছে ঠিকই, কিন্তু পেয়ে গেছেন আত্মার পরিপূর্ণতা। তিনি বলেন, ‘এলাকার স্কুলগুলোতে সপ্তাহে একদিন বই নিয়ে যেতে চাই। ছাত্রছাত্রীদের হাতে বই তুলে দিতে পারব। আর ভাবছি, একটা আলোর স্কুল আর বিজ্ঞান ক্লাব করব।’
এই অবিশ্বাস্য উদ্যোগের কথা পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। ২০২৫ সালের ৭ জুলাই ‘১০০০ লাইব্রেরী ম্যাগাজিন’-এ প্রকাশিত হয় জন বার্নসের লেখা একটি প্রতিবেদন—‘নিজ গ্রামের জন্য পাঠাগার গড়ে তোলা এক বাংলাদেশি দিনমজুরের গল্প’ শিরোনামে। এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে একজন নিরক্ষর দিনমজুর তার সংকল্প আর বইয়ের প্রেম দিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি গ্রামীণ আলয়। সেই আলোর খোঁজে এখন প্রতিদিন আসে শত শত পাঠক।