ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনের শিকার শিবির নেতা, বিচারের আশায় ১১ বছর পার

নবাব আব্দুল লতিফ হল শাখা শিবিরের সেক্রেটারি মো. রাসেল
নবাব আব্দুল লতিফ হল শাখা শিবিরের সেক্রেটারি মো. রাসেল  © সংগৃহীত

ঘটনাটি ২০১৪ সালের ১৬ জুন। সেদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ছাত্রশিবিরের কয়েকজন নেতা-কর্মী ক্যাম্পাসে আসেন পরীক্ষা দিতে। খবর পেয়ে তৎকালীন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম তৌহিদ আল হোসেন তুহিনের নেতৃত্বে ২০ থেকে ২৫ জন নেতা-কর্মী ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। ঘটনাস্থলে কিছুক্ষণ পরেই দুই ছাত্রশিবির নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। 

তবে তৎকালীন নবাব আব্দুল লতিফ হল শাখা শিবিরের সেক্রেটারি মো. রাসেল আলমকে আটকে রাখে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। চাপাতি দিয়ে তার পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কেটে নেয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন স্থানে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে তাকে গুরুতর জখম করে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

ঘটনার ১১ বছর পর নতুন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় এসেছে ঘটনাটি। সেদিন আসলে কী ঘটেছিল রাসেলের সাথে? তা জানতে কথা হয় শিবিরের সাবেক এই নেতার সাথে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। 

রাসেল আলাম গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার ভরতখালি ইউনিয়নের চিঁথুলিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। বাবা-মায়ের পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয় এবং প্রথম ছেলে। তার ছোট এক ভাই আর এক বোন ২০০৩ সালে পুকুরে ডুবে এক সাথে মারা যান বলে জানান রাসেল। 

আরও পড়ুন: ভাঙা নয়, মূল নকশায় ফিরছে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ভাস্কর্যটি 

ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনায় প্রতিবেদককে রাসেল আলম বলেন, সেদিন পরীক্ষা দিতে এসেছিলাম৷ জানতে পেরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভবনের নিচ গেট বন্ধ করে দেয়। আমি তখন ভেতরে আটকা পড়ে যাই। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে হাসিব ভাই (ছাত্রশিবির সাবেক নেতা) ও মঞ্জুর ভাইকে (ছাত্রশিবির সাবেক নেতা) গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমাকে পুলিশ কিছু না বলায় আমিও চুপচাপ থাকি। গেটের বাইরে পুলিশের আরেকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু তখনও আমি বুঝতে পারিনি আমাকে নিয়ে ওরা কী জঘন্য চক্রান্ত করে রেখেছে! 

রাসেল আরো বলেন, বেলা তিনটার দিকে প্রায় ২৫-৩০ জন অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ আমাকে ঘিরে ফেলে এবং একটা রুমের ভেতরে নিয়ে যায়। তাদের হাতে বন্দুক, চাপাতি, হকিস্টিকসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র। তারা এক ঘণ্টা ধরে আমাকে আটকে রেখে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। তৎকালীন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন তুহিন ছিল সেখানে। বেলা চারটার দিকে আমি তাকে বলি, 'তোমাদের কারো তো আমি কোনো ক্ষতি করিনি, আমাকে যেতে দাও।' 

এই বলে পিছন ফিরে পা বাড়াতেই রিনেট নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী আমাকে পিঠে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। কী হলো বোঝার জন্য ঘুরে দেখামাত্রই অন্য কেউ আমার হাতে আরেকটা চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। আমার হাত কবজি থেকে কেটে চামড়ার সাথে ঝুলতে থাকে। 

পায়ের গোড়ালি কর্তনের বিষয়ে রাসেল বলেন, আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হওয়ারও সময় পাইনি। ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল আহমেদ রুনু (পরবর্তীতে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ সম্পাদক) আমার দুই পায়ে গুলি করে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। আমাকে এই অবস্থায় ফেলে তারা সবাই চলে যাচ্ছিল, কিন্তু ছাত্রলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া (পরবর্তীতে রাবি ছাত্রলীগ সভাপতি) ফিরে এসে চাপাতি নিয়ে আমার পায়ে কোপাতে থাকে। আমি আমার পায়ের অনুভূতি পাচ্ছিলাম না। আমাকে ওরা আঘাত করছে অথচ আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভয়ংকর কিছু হয়ে গেছে সেটাও বুঝতে পারিনি।

ঘটনার বিবরণ তুলে তিনি আরো বলেন, আমাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ওরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখি আমার এক পা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও যেই আমি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ছিলাম, মুহূর্তের মধ্যেই সেই আমি ছাত্রলীগের নৃশংসতায় একেবারে পঙ্গু হয়ে গেলাম। রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছিল আমার শরীর দিয়ে। সারা শরীর ভালোভাবে দেখলাম, মনে হলো আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি। 

মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম ও কয়েকবার তওবা পরে নিলাম। এরপর মনে মনে বলছিলাম, হে আল্লাহ আমি শহিদি মৃত্যু চেয়েছিলাম, তুমি কবুল করেছ, আলহামদুলিল্লাহ। তুমি শুধু আমার বাবা-মাকে ধৈর্যধারণ করার তৌফিক দিও। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। আমাকে নিয়ে তাদের দুনিয়ার সকল স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেল, তুমি তাদের আখিরাতে প্রতিদান দিও। 

মেডিকেলের ডাক্তার অপারেশনে অস্বীকৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, এরপর আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। এভাবে বেশ কিছুটা সময় নিজের রক্তের ভিতরে ডুবে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে পুলিশ আসে। তখনকার মতিহার থানার ওসি আলমগীর আমাকে পুলিশ ভ্যানে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের প্রধান ডা. বি. কে. দাম আমার অপারেশন করতে অস্বীকৃতি জানায়।

রক্তক্ষরণ আটকাতে আমার পা বেঁধে রাখা হয়েছিল। পায়ে কোনো অনুভূতি না থাকলেও কোমরে প্রচণ্ড ব্যাথা করছিল। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে যন্ত্রণায় চিৎকার চেঁচামেচির পর আমার অপারেশন শুরু করে। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা অপারেশন শেষে আমাকে আইসিইউতে শিফট করা হয়। তারপর আইসিইউতে আমাকে পুরানো মামলায় গ্রেফতার করা হয়। আমি পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে থাকি। আমার সাথে কারো দেখা করার ব্যাপারেও বিধিনিষেধ ছিল। এই অবস্থায় কাউকে গ্রেফতার করা হতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিল না। 

আরও পড়ুন: অধ্যাপক কলিমউল্লাহসহ বেরোবির সাবেক দুই ভিসির বিরুদ্ধে মামলা

তিনি আরো বলেন, জেলেই আমি চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা দিই, তবে এক বিষয়ে ফেল করি। কারাগারে আমাকে হুইলচেয়ার পর্যন্ত দেওয়া হয়নি, পা হারিয়েও লাফিয়ে চলাফেরা করতে হয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ দিন পর মুক্তি পেলেও আবার ডিবি পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। নির্যাতনকারীরা পুরস্কৃত হয়, কেউ শাস্তি পায় না। নকল পা নিয়ে আমি ঢাকায় চিকিৎসা ও পড়ালেখা চালিয়ে যাই। 

তবে পরীক্ষা দিতে না পারায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রত্ব বাতিল হয়। পরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করি। মামলা ও নির্যাতনের চাপ আর নিতে না পেরে অবশেষে ২০২২ সালে লন্ডনে চলে যাওয়ার সুযোগ পাই। বর্তমানে আমি লন্ডনের একটি ল-ফার্মে কর্মরত।

অভিযুক্তদের রাষ্ট্রীভাবে শাস্তি চেয়ে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে তাদের ব্যক্তিগত কোনো রাগ ছিল না, আমি শুধু শিবির করতাম—এই ছিল আমার অপরাধ। তাই আমি তাদের ব্যক্তিগতভাবে ক্ষমা করে দিয়েছি। কারণ তারা রাসেলকে মারেনি, শিবির রাসেলকে মেরেছে। আমি জানি, প্রতিশোধ নিয়ে আমার কিছুই ফিরে আসবে না। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই অন্যায়ের বিচার চাই। যাতে আর কোনো শিবিরের রাসেলকে এভাবে হত্যার উদ্দেশ্য নির্যাতন করতে সাহস না পায়।

তিনি আরও বলেন, ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার কারণে বিবিএ সার্টিফিকেট পাইনি। তাই  আমি আমার বিবিএ-এর সার্টিফিকেট ফিরে পেতে চাই। আমার বাবা আমার কারণে ব্রেন স্ট্রোক করে মারা যায়, তাই আমার পরিবার এবং আমাকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চাই।


সর্বশেষ সংবাদ