সাধারণ ও মাদ্রাসার ১০ বোর্ডে এইচএসসির বৃত্তি মিললেও বঞ্চিত কারিগরি শিক্ষার্থীরা

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের লোগো
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের লোগো  © টিডিসি সম্পাদিত ও সংগৃহীত

চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় দেশের ৯টি জেনারেল শিক্ষা বোর্ডের পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী মেধা ও সাধারণ বোর্ড বৃত্তির আওতায় এলেও একই ধরনের ফলাফল ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি বৃত্তির তালিকার বাইরে রয়েছেন। ভালো ফলাফল এবং বাস্তবমুখী দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বোর্ডভিত্তিক নীতির কারণে কারিগরি শিক্ষার্থীদের বৃত্তির ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এতে একদিকে মেধাবী কারিগরি শিক্ষার্থীরা ন্যায্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

জানা যায়, ২০২৫ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে রাজস্ব খাতভুক্ত মেধা ও সাধারণ বৃত্তির বোর্ডভিত্তিক কোটা বণ্টনের তালিকা প্রকাশ করে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ ৯টি জেনারেল বোর্ডে এ বছর এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে এবার সাড়ে ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেবে সরকার। তাদের মধ্যে ১ হাজার ১২৫ জনকে মেধাবৃত্তি ও ৯ হাজার ৩৭৫ জনকে সাধারণ বৃত্তি দেবে বোর্ডগুলো। পাশাপাশি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত কোটায় মেধাবৃত্তি ও সাধারণ বৃত্তি প্রদান করে থাকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। বোর্ডগুলোর মেধাবৃত্তির হার মাসিক ৮২৫ টাকা ও এককালীন বার্ষিক অনুদান ১ হাজার ৮০০ টাকা। সাধারণ বৃত্তির হার মাসিক ৩৭৫ টাকা ও এককালীন বার্ষিক অনুদান ৭৫০ টাকা।

আরও পড়ুন: জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা শুরু কাল, মানতে হবে যেসব নির্দেশনা 

অন্যদিকে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৭৭ হাজার ২৯১ জন ছাত্র এবং ২৮ হাজার ৩১৯ জন ছাত্রীসহ মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৬১০ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৬৬ হাজার ১৮৫ জন শিক্ষার্থী সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে এবার ৩৯৭ জন ছাত্র এবং ১ হাজার ২১৩ জন ছাত্রীসহ মোট ১ হাজার ৬১০ জন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ গ্রেড পয়েন্ট গড়-৫ (জিপিএ-৫) পেয়েছেন। ফলে বৃত্তির হারে জেনারেল ও কারিগরি বোর্ডের মধ্যে শুধুমাত্র বোর্ডভিত্তিক নীতির কারণে কারিগরি শিক্ষার্থীদের বৃত্তির ক্ষেত্রে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

কারিগরি শিক্ষা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি হলেও বৃত্তি নীতিতে এ খাতের শিক্ষার্থীদের উপেক্ষা অত্যন্ত দুঃখজনক। একই যোগ্যতা ও ফলাফল থাকা সত্ত্বেও শুধু বোর্ডভিত্তিক বৈষম্যের কারণে কারিগরি শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে, যা ন্যায়ের পরিপন্থী- উমর ফারুক, শিক্ষাবিদ ও সহযোগী অধ্যাপক

কারিগরি শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বাস্তবমুখী ও কর্মসংস্থাননির্ভর শিক্ষায় দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি ভালো ফল করলেও তারা বৃত্তির ক্ষেত্রে ন্যায্য স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা ও বাস্তবমুখী শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় নিলে কারিগরি শাখায় বৃত্তির সংখ্যা আরও বেশি হওয়া উচিত ছিল। অথচ দীর্ঘদিন ধরেই এই বোর্ডকে বৃত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে অবহেলা করা হচ্ছে। একই জিপিএ বা সমমানের ফলাফল থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বোর্ডভেদে বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়াকে বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন তারা।

কারিগরি বোর্ডের আওতাধীন জয়নন্দ ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা মুসা ইসলাম বলেন, ‘আমরা একই এইচএসসি পাস করি, একই বয়সে পড়াশোনা করি, কিন্তু বৃত্তির ক্ষেত্রে আমাদের মূল্যায়ন আলাদা। তাদের মেধার মূল্যায়ন করা হলেও, আমাদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। এতে বৈষম্যের পাশাপাশি আর্থিকভাবেও আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এতে কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে।’

আরও পড়ুন: ইবতেদায়ি ও দাখিল বৃত্তি পরীক্ষা শুরু রবিবার, একগুচ্ছ নির্দেশনা

শিক্ষাবিদদের মতে, দেশের টেকসই শিল্পায়ন, প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বাস্তবমুখী দক্ষতা ও কর্মসংস্থান উপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই ধারার শিক্ষার্থীরাই ভবিষ্যতে শিল্পকারখানা, প্রযুক্তি খাত ও উৎপাদন ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। অথচ বৃত্তি ও বিভিন্ন প্রণোদনার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্য বজায় থাকলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষায় আগ্রহ হারাবে এবং সাধারণ ধারার শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়বে।

তাদের মতে, এইচএসসি সমমানের পরীক্ষায় জেনারেল ও মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বৃত্তির আওতায় এলেও একই ফলাফল ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের অবহেলা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে একদিকে শিক্ষাক্ষেত্রে সমতার নীতি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষার প্রতি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বের ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবতার স্পষ্ট সাংঘর্ষিক চিত্র ফুটে উঠছে। ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক বৃত্তি নীতিমালা প্রণয়ন ছাড়া কারিগরি শিক্ষাকে আকর্ষণীয় ও টেকসই করা সম্ভব নয়।

আমরা ইতিমধ্যে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য জুনিয়র বৃত্তি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আগামী দিনে আমাদের লক্ষ্য হবে, যেন এইচএসসি বোর্ডের শিক্ষার্থীরাও যথাযথভাবে বৃত্তি পেতে পারে। আমরা চাই, কোনো শিক্ষার্থীই এ ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন এবং প্রত্যেকের শিক্ষাজীবন সমান সুযোগ ও মর্যাদার ভিত্তিতে এগিয়ে যায়- প্রকৌশলী আনোয়ারুল কবীর, পরিচালক (কারিকুলাম), কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেটস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ উমর ফারুক বলেন, কারিগরি শিক্ষা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তি হলেও বৃত্তি নীতিতে এ খাতের শিক্ষার্থীদের উপেক্ষা অত্যন্ত দুঃখজনক। একই যোগ্যতা ও ফলাফল থাকা সত্ত্বেও শুধু বোর্ডভিত্তিক বৈষম্যের কারণে কারিগরি শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে, যা ন্যায়ের পরিপন্থী। অবিলম্বে বৃত্তি নীতিতে সমতা নিশ্চিত করে কারিগরি শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন—না হলে মেধাবীরা এই ধারায় আগ্রহ হারাবে এবং দেশের দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সাবেক সচিব খ. ম. কবিরুল ইসলাম বলেন, নীতিগতভাবে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও এইচএসসি বোর্ড বৃত্তি পাওয়ার যোগ্য। এ ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের বৈষম্য করার সুযোগ নেই। ভবিষ্যতে কারিগরি শিক্ষাকেই আমরা মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। সেক্ষেত্রে এই শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলিত। এখন সময় এসেছে এই ব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর। আমরা যদি বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চাই, তাহলে কারিগরি শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কারিগরি শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে ন্যায্য, সমতাভিত্তিক ও যুগোপযোগী বৃত্তি নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি।

এ ব্যাপারে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিচালক (কারিকুলাম) প্রকৌশলী আনোয়ারুল কবির বলেন, কারিগরি শিক্ষার্থীরা একই এইচএসসি সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো ফলাফল অর্জন করলেও বৃত্তি ও প্রণোদনার ক্ষেত্রে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।  কারিগরি শিক্ষা জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ায় এই খাতকে উৎসাহিত করতে বিশেষ প্রণোদনা প্রয়োজন। ন্যায্য বৃত্তি ও সমতাভিত্তিক সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে কারিগরি শিক্ষায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়বে এবং দেশের শিল্প ও প্রযুক্তিখাত দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবে।

তিনি বলেন, আমরা ইতিমধ্যে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য জুনিয়র বৃত্তি চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আগামী দিনে আমাদের লক্ষ্য হবে, যেন এইচএসসি বোর্ডের শিক্ষার্থীরাও যথাযথভাবে বৃত্তি পেতে পারে। আমরা চাই, কোনো শিক্ষার্থীই এ ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন এবং প্রত্যেকের শিক্ষাজীবন সমান সুযোগ ও মর্যাদার ভিত্তিতে এগিয়ে যায়।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!