বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার
মন্ত্রণালয়ের বিতর্কিত বিধিতে আটকা আড়াই হাজার প্রভাষকের পদোন্নতি
- ১৬ নভেম্বর থেকে ‘নো প্রমোশন নো ওয়ার্ক’ কর্মসূচি
- মন্ত্রণালয়ের নিরব ভূমিকায় ক্ষুব্ধ শিক্ষা পরিবার
- শিহাব উদ্দিন
- প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:১৫ PM , আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:১৯ PM
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিতর্কিত এক বিধির জটিলতায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় আড়াই হাজার প্রভাষকের পদোন্নতি আটকে গেছে। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সব যোগ্যতা অর্জন করলেও ৩২তম থেকে ৩৭তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে প্রভাষক পদেই কর্মরত রয়েছেন। দীর্ঘ ১২ বছরেও তাদের পদোন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় ‘নো প্রমোশন, নো ওয়ার্ক’ আন্দোলন কর্মসূচিতে যাচ্ছেন তারা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, চলতি বছরে জুন ও নভেম্বর মাসে দু’দফায় একাধিকবার ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি (ডিপিসি) সভা করেও মামলা জটিলতার অযুহাতে পদোন্নতির আদেশ জারি করছে না মন্ত্রণালয়। এতে চরম ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন পদোন্নতি বঞ্চিতরা। আগামী ১৬ নভেম্বর থেকে ‘নো প্রমোশন নো ওয়ার্ক’ কর্মসূচি পালন করবেন পদোন্নতি প্রাত্যাশিরা।
৩২তম ও ৩৩তম বিসিএস ব্যাচের প্রায় চার শতাধিক প্রভাষক চাকরিতে যোগদানের এক যুগ পরেও প্রথম পদোন্নতি পাননি। এছাড়া ৩৪তম বিসিএস ১০ বছর ৩৫তম বিসিএস ৯ বছর বছর এবং ৩৬তম বিসিএস ৮ বছর, ৩৭তম বিসিএস ৭ বছরে পার করলেও পদোন্নতি পাচ্ছেন না। প্রভাষক হতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির লক্ষ্যে গ্রেডেশনভুক্ত কর্মকর্তার সংখ্যায় ৩২তম বিসিএসে রয়েছে ৫৪ জন, ৩৩তম বিসিএসে রয়েছে ৩৬১ জন, ৩৪তম বিসিএসে ৬৩১ জন, ৩৫তম বিসিএসে ৭৪০ জন ৩৬ বিসিএসে ৪৬০ জন, এবং ৩৭তম বিসিএসে ১৫৩ জন।
শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রণালয়ের বিতর্কিত ২০০০ সালের বিধিমালা প্রণয়নকালে নেওয়া হয়নি আইন মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত। বিতর্কিত এই বিধি ৬(৫) অনুযায়ী আত্মীকৃত শিক্ষকগণ সকল যোগ্যতা অর্জন করার পর নিয়োমিতকরণ হলে তখন ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা ২০২৪ সালে একটি বিশেষ সময়ে বিধিমালা ২০০০ অমান্য করে একটি বিশেষ মহলকে সুবিধা দিতে একই তারিখ ও স্মারকে স্থলাভিষিক্ত করে ৫৪টি আদেশ জারি করে। এসব আদেশে প্রায় ২০০০ আত্মীকৃত শিক্ষক ক্যাডার হিসেবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। এই ৫৪টি অবৈধ আদেশ বাতিলের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ ক্যাডার কর্মকর্তারা ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যম হয়ে সিনিয়র সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন।
মাউশি ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১৩ জানুয়ারী পর্যন্ত ১১ টি আবেদনের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে প্রতিবেদনসহ ‘মীমাংসা’ চেয়ে চিঠি দিলেও সেই চিঠির বিষয়ে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের পদোন্নতি গত ১৭ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ পদোন্নতির জন্য চলতি বছরের ৪ জুন প্রথম দফায় ডিপিসি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই বৈঠকের পর গত পাঁচ মাস পার হলেও পদোন্নতি দেয়া হয়নি। আত্তীকৃত শিক্ষকদের মামলার অজুহাতে এ পদোন্নতি প্রক্রিয়া বন্ধ রাখে মন্ত্রণালয়। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ আদালত পদোন্নতিতে স্থগিত নির্দেশ দেননি, অথচ মন্ত্রণালয়ে পদোন্নতি স্থগিত রেখেছে।
‘শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের পদোন্নতি দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তবে মন্ত্রণালয় ডিপিসি করেছে। আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রভাষকদের পদোন্নতির বিষয়টি সমাধান হবে। শিক্ষা ক্যাডার প্রভাষক পরিষদের নো প্রমোশন নো ওয়ার্ক কর্মসূচির প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’— সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মাসুদ রানা, সদস্য সচিব, বিসিএস শিক্ষা সমিতি
ভুক্তভোগী শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তরা ৪ জুনের ডিপিসির পর গত ৬ মাস ধরে মন্ত্রণালয় ও মাউশি কর্তৃপক্ষকে বিধি সংশোধন ও মামলার বিষয়টি সুরাহা করে পদোন্নতির দাবি জানান। কিন্তু কোন সমাধান না পেয়ে পদোন্নতির অপেক্ষা দীর্ঘ হতে থাকায় শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে নামেন ক্ষুব্ধ প্রভাষকরা। এ প্রেক্ষাপটে গত ৩০ অক্টোবর পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তারা ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার প্রভাষক পরিষদ’ ব্যানারে দ্রুত পদোন্নতির দাবিতে মাউশির সামনে অবস্থান, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে।
আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৬ নভেম্বর ও পরবর্তীতে একাধিক ডিপিসি সভা করে। ডিপিসি কমিটি পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নিলেও কোন আদেশ জারি করেনি। মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, আত্মীকৃতদের মামলা জটিলতার কারণে আদেশ জারির মুহূর্তে হঠাৎ আটকে যায় ১২ বছর ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি।
এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) মো. মজিবর রহমানকে কল করা হলে তিনি ‘খাচ্ছেন’ বলে পরবর্তীতে কল দিতে বলেন। তবে পরে একাধিকবার তাকে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে আন্দোলনকারী প্রভাষকরা গত ৯ নভেম্বর তারা সারা দেশে সকল সরকারি কলেজের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি এবং সকল জেলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সম্মেলনে তারা ঘোষণা দেন, ১৩ নভেম্বরের মধ্যে পদোন্নতির আদেশ জারি না হলে ১৬ নভেম্বর ‘নো প্রমোশন, নো ওয়ার্ক’ লাগাতার কঠোর কর্মসূচি পালন করবেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, অন্য ক্যাডারের ৩৬তম ব্যাচ ২০২৩ সালে এবং ৩৭তম ব্যাচ ২০২৪ সালে পদোন্নতি পেয়েছে। চলতি সপ্তাহেও বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারে পাঁচ শতাধিকেরও অধিক কর্মকর্তার সুপারনিউমারি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অথচ শিক্ষা ক্যাডারে প্রভাষক পর্যায়ের ৩২-৩৭ ব্যাচ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতির সব যোগ্যতা অর্জন করেও পদোন্নতি পাচ্ছে না। ভুক্তভোগী ক্যাডার কর্মকর্তারা আরো জানান, শিক্ষা ক্যাডারের ৩২তম ব্যাচ থেকে ৩৭তম ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতি যোগ্যদের অনতিবিলম্বে চাই। সরকার ইচ্ছে করলেই আমাদের পদোন্নতি দিতে পারে। এজন্য প্রয়োজন উদ্যোগ গ্রহণ করা ও যথেষ্ট সদিচ্ছা থাকা। কেননা পদোন্নতিযোগ্যদের তালিকায় থাকা ৩৫ ব্যাচ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে সরকারের কোন আর্থিক সংশ্লেষ থাকছে না।
জানা গেছে. ৩২তম ও ৩৩তম বিসিএস ব্যাচের প্রায় চার শতাধিক প্রভাষক চাকরিতে যোগদানের এক যুগ পরেও প্রথম পদোন্নতি পাননি। এছাড়া ৩৪তম বিসিএস ১০ বছর ৩৫তম বিসিএস ৯ বছর বছর এবং ৩৬তম বিসিএস ৮ বছর, ৩৭তম বিসিএস ৭ বছরে পার করলেও পদোন্নতি পাচ্ছেন না। প্রভাষক হতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির লক্ষ্যে গ্রেডেশনভুক্ত কর্মকর্তার সংখ্যায় ৩২তম বিসিএসে রয়েছে ৫৪ জন, ৩৩তম বিসিএসে রয়েছে ৩৬১ জন, ৩৪তম বিসিএসে ৬৩১ জন, ৩৫তম বিসিএসে ৭৪০ জন ৩৬ বিসিএসে ৪৬০ জন, এবং ৩৭তম বিসিএসে ১৫৩ জন।
বিসিএস শিক্ষা সমিতির সদস্য সচিব সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মাসুদ রানা খান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষকদের পদোন্নতি দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। তবে মন্ত্রণালয় ডিপিসি করেছে। আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রভাষকদের পদোন্নতির বিষয়টি সমাধান হবে। শিক্ষা ক্যাডার প্রভাষক পরিষদের নো প্রমোশন নো ওয়ার্ক কর্মসূচির প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে মাউশির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর বি এম আব্দুল হান্নানকে কল করা হলে তিনি মিটিংয়ে রয়েছেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন।