ছাত্রদলের কোন্দলে-সংঘর্ষে ১০ মাসে নিহত ৪১
- মো. আবদুর রহমান
- প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ০৬:১০ PM , আপডেট: ২২ জুন ২০২৫, ১২:১১ PM
অভ্যন্তরীণ কোন্দল-আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ৫ আগস্ট পরবর্তী ১০ মাসে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সংঘর্ষ ও বিরোধে প্রাণ হারিয়েছেন সংগঠনটির ৪১ ব্যক্তি। যাদের মধ্যে ৩১ জনই ছাত্রদলের নেতাকর্মী। এছাড়া আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিকের বেশি। এসব ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে নেতাকর্মীদের মতবিরোধ, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের মধ্যে মতভিন্নতা, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, চাঁদাবাজি-ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণসহ নানা বিষয়।
আবার কিছু ঘটনায় ছাত্রদলের নেতাকর্মীকে টার্গেট করে হত্যার শিকারের ঘটনা ঘটে। এই হত্যাগুলোর মধ্যে আলোচিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য এবং রাজধানীর বেসরকারি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল কর্মী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ হত্যাকাণ্ড। এ দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দ্রুত বিচার দাবি করেছে সংগঠনটি। এই দুই শিক্ষার্থী হত্যার বিচারে সংগঠনটিকে রাজপথে আন্দোলনও করতে দেখা গেছে। এছাড়া বাকি নেতাকর্মীদের হত্যার বিচারের দাবি তুলতে দেখা যায়নি সংগঠনটির পক্ষ থেকে। শুধু সংগঠন থেকে বহিষ্কারেই সীমাবদ্ধ ছিল ছাত্র সংগঠনটি।
বিশ্লেষকদের মতে, আদর্শ থেকে বিচ্যুতি এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি উপেক্ষা করে সংগঠন চালানোর কারণেই এ পরিস্থিতির উদ্ভব। দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্রদল একটি আদর্শিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছিল, কিন্তু ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সংগঠনটির মধ্যে সংঘর্ষ, খুনাখুনি ও বিভাজনের প্রতীক হয়ে উঠছে।
ছাত্র রাজনীতি কোনোভাবেই সহিংসতা বা আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে চলতে পারে না। বরং তা হতে হবে গণতান্ত্রিক, নৈতিক এবং শিক্ষার্থীবান্ধব। তা না হলে ছাত্র রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও আস্থা দিন দিন আরও কমে যাবে—অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে শুরু হয় ছাত্রদলের রাজনীতিতে উত্তেজনা ও সংঘর্ষের নতুন পর্ব। সর্বশেষ গত ১০ জুন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে স্থানীয় ও যুবদলের নেতাকর্মীদের হাতে আটক নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের এক নেতাকে ছাড়িয়ে নেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও যুবদলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে যুবদল নেতার ভাই মামুন হোসেন ভূঁইয়া (৩২) নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সাবেক প্রচার সম্পাদক জায়েদুল ইসলাম বাবু ও সমর্থকরা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি চালালে মামুন গুলিবিদ্ধ হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মামুন মারা যান। এ ঘটনার পর দিন ১১ জুন বাবুকে প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল। ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ঘেঁটে দেখা যায়, গত ১০ মাসে দেশব্যাপী অন্তত ১০৬টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যার বেশিরভাগই অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব থেকে সৃষ্ট। এসব ঘটনায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন শেরপুর, পাবনা, রাজবাড়ী, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, জয়পুরহাট, নোয়াখালী, বাগেরহাট, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী এবং ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ছাত্রদল কর্মীরা।

নিহতদের মধ্যে রয়েছেন- শেরপুর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শ্রাবণ (৩০), পাবনার ঈশ্বরদী রূপপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামের স্থানীয় ওয়ার্ড ছাত্রদলের কর্মী শচীন বিশ্বাস সাজু (২২), দৌলতদিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের কর্মী ফারুক সরদার (২৫), সিলেট কানাইঘাট পৌর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আবদুল মুমিন (২৯), ছাত্রদলের আহবায়ক জয়নুল আহমদ জয়ের বড় ভাই শেখ উদ্দিন (৫০), নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে কাঞ্চন পৌরসভা ছাত্রদলের সদ্য সাবেক আহ্বায়ক পাভেল মিয়া (৩০), নরসিংদী মেহেড়পাড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সদস্য হুমায়ুন কবির (৩০), জয়পুরহাট শহর ছাত্রদল শাখা কমিটির জেষ্ঠ্য যুগ্ম আহ্বায়ক বিপ্লব আহম্মেদ পিয়াল (৩০)।
নোয়াখালীর সদর ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী মো. আবুল হোসেন রাফি (১৯), বাগেরহাট মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী সাফায়েত তালুকদার (২৫), প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের কর্মী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ। দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মজনুর রহমান মজনুকে (৩৫), নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় মো. অপূর্ব (২৫), এনায়েতপুর থানার সদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কবির হোসেন (২৮), কুশোডাঙ্গা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার হোসেন তুরান, দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের ছাত্রদলের সাবেক সম্পাদক মো. রাশেদ হোসেন রাজু।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মুমুরদিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আশিক খাঁ (২৪), সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কুশোডাঙ্গা ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার হোসেন তুরান। ভোলার মনপুরায় ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রাশেদ। উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের বড় দুলালি গ্রামের রাশেদ সিকদার (২৪), পটুয়াখালীর বাউফলে মো. সুজন হাওলাদার (৩০), বিএনপি ও ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত মোহাম্মদ আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্যকে (২৫)।

ভয়াবহ এই সংঘর্ষে জাতীয় গণমাধ্যমে ও দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা গেছে, ২০২৪ সালের আগস্টে ২ জন, সেপ্টেম্বরে ১, অক্টোবরে ১, নভেম্বরে ১, ডিসেম্বরে ৩, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ১, ফেব্রুয়ারিতে ২, মার্চে ৭, এপ্রিল ও মে মাসে যথাক্রমে ২ ও ৫ জন নিহত হন। তবে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তারের আরও কয়েকটি হত্যার খবর সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে এলেও সেগুলোতে রাজনৈতিক যোগসূত্র না থাকায় এ প্রতিবেদনে সেগুলো উল্লেখ করা হয়নি। যেমন– চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতাসহ নিহত ২, আহত ৪।
স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য, সরেজমিন অনুসন্ধান এবং দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ সহিংসতা ঘটেছে অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কেন্দ্র করে। ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি ও অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতাদের দ্বন্দ্ব এসব ঘটনায় অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। একইসঙ্গে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় আধিপত্য বিস্তার ও নেতৃত্বের প্রশ্নে বিভক্ত দুটি পক্ষ প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে পিরোজপুর, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, চাঁদপুর, ভোলা ও চট্টগ্রাম এলাকায় এসব সংঘর্ষের মাত্রা ছিল গুরুতর। অনেকে চাঁদাবাজি, বালুমহাল ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও ছাত্রদলের নাম জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ তুলেছেন।
মাঠপর্যায়ের বহু নেতাকর্মী অভিযোগ করেছেন, বর্তমানে ছাত্রদলের রাজনীতিতে আদর্শ নয়, বরং আধিপত্য বিস্তারই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দলীয় কর্মসূচির চেয়ে নিজের অবস্থান রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন অধিকাংশ নেতাকর্মী। নতুন-পুরনো কমিটির মধ্যে সংঘর্ষ, নেতৃত্বের প্রশ্নে বিভাজন এবং অভ্যন্তরীণ গঠনতন্ত্রকে উপেক্ষা করে কেন্দ্রের একক সিদ্ধান্ত আরোপ– সব মিলিয়ে সংগঠনটির ভাবমূর্তি দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে। একই কমিটির মধ্যেই মাঝে মাঝে বিরোধের সৃষ্টি হয়, যার সর্বশেষ পরিণতিতে রক্তপাত ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
.jpg)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস বলেন, ছাত্রসংগঠনগুলোর প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মানুষের কাছে নিজেদের আদর্শ ও লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা। তিনি মনে করেন, এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের আদর্শ, নৈতিকতা ও শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠা উচিত।
ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ছাত্রসংগঠনগুলো যেন ব্যক্তিস্বার্থ নয়, বরং সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ক্যাম্পাসে তারা যেন সহশিক্ষা, অধিকার এবং গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ তৈরি করে। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব নির্বাচনের সময় ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম যেন শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের আদর্শ ও কর্মসূচি তুলে ধরার একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে, সেটিই কাম্য।’
অধ্যাপক মাহবুবুর রহমানের মতে, ছাত্র রাজনীতি কোনোভাবেই সহিংসতা বা আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে চলতে পারে না। বরং তা হতে হবে গণতান্ত্রিক, নৈতিক এবং শিক্ষার্থীবান্ধব। তা না হলে ছাত্র রাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও আস্থা দিন দিন আরও কমে যাবে।
নেতাকর্মীদের মধ্যে মতবিরোধসহ নানান অভিযোগে সংঘর্ষের ঘটনার বিষয়ে জানতে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির সাথে কয়েকদফা যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।