মানুষ হিসেবে আমি বিব্রত!

এ এম নূর উদ্দীন হোসাইন
এ এম নূর উদ্দীন হোসাইন   © টিডিসি ফটো

যে শব্দটা উচ্চারণ করতেই কেমন যেন অস্বস্তিকর লাগতো, এখন সেই শব্দটা ছোট বড় সবার মুখে মুখে। বীভৎস সব ঘটনা অনবরত আসছে। আগে দেখা যেত নির্দিষ্ট দু-এক শ্রেণির বখাটে মানুষের মধ্যেই এই জঘন্য কাজটি সীমাবদ্ধ ছিল। এখন বৃদ্ধ-তরুণ, আলেম-আমলা কেউ বাদ যাচ্ছে না এই ইস্যুতে। এ যেন সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিযোগিতা চলছে।

উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশে বা সমাজে ধর্ষণকে সব থেকে বড় এবং ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। একই সঙ্গে ধর্ষণের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানও সেভাবে নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু কিছু কিছু দেশে ধর্ষণের সাজা মারাত্মক না হওয়ায় ধর্ষণ এমন রূপ লাভ করে যে তা নিয়ে পুরো সমাজে মহামারী অবস্থার সৃষ্টি হয়।

সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা নোয়াখালির বেগমগঞ্জের ঘটনায় ধর্ষকরা গ্রেপ্তার হয়েছে। এটি অনেকের কাছেই খুশির সংবাদ। কিন্তু আমার কাছে গত কিছুদিন আগে ধর্ষণের হাস্যকর শাস্তি হিসেবে চাপাইনবয়াবগঞ্জের ৭২ হাজার টাকার জরিমানার চেয়ে এই গ্রেপ্তার আরো লেইম মনে হচ্ছে। কারণ সেটির লঘু হলেও চুড়ান্ত একটি জরিমানা বা শাস্তি হয়েছে। কেননা ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে দেশের বিদ্যমান আইনে তাঁদের বিচার এবং চুড়ান্ত বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে জনমনে সংশয় আছে।

এসব ধর্ষণের ঘটনায় আমরা পাবলিকরা প্রতিবাদ, প্লেকার্ড, ধর্না কেউ কেউ ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে গবেষণা করি, আর আইনের সিস্টেমে তদন্ত কমিটি, তদন্ত, সমঝোতার চেষ্টা, ঘুষ দেওয়া, জামিন এবং ফের ধর্ষণ ইত্যাদি আবার রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের লোক, ধমক আর রাজনীতিকরণ পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে আলোচনার নতুন একটি টপিক পাওয়া কেবল।

খাদিজাকে সিলেটের বদরুল, ক্যান্টমেন্টের তনু, বরিশালের বানারিপাড়ায় মা-মেয়েকে
একসাথে ধর্ষণ করে মাথা নেড়ি করে দেয়া প্রভাবশালী তুফান, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে দিনের বেলা যুবতি মেয়ের সামনে তার মাকে দল বেঁধে ধর্ষণ করার পর প্রহার করা আসামি ধর্ষক রুহুল আমীনের ফাঁসির দাবি উঠলেও ফাঁসি কিন্তু হয়নি এবং বেগমগঞ্জের আগে সর্বশেষ এমসি কলেজের ঘটনায় আসামীরা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদেরও কিন্তু ফাঁসি হবে না। এভাবে আরো কতো ধর্ষণ হচ্ছে তার হিসাব রাখে কে?

গত রোববার রাতে এটিএন নিউজের একটি টকশো দেখছিলাম। সেখানে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রসঙ্গে সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু সাহেব পুলিশের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে দাবি করছিলেন, দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন নারী ধর্ষিত হয়। আবার ধর্ষণের সব ঘটনা থানা-পুলিশ পর্যন্ত কিন্তু যায়নি। তারপরও এই পরিসংখ্যান কতটাইনা ভয়ঙ্কর! আর অন্ধকারের তালিকায় সাইলেন্ট রেপিস্টের সংখ্যা নাজানি কত ভয়ংকর কে বলবে!

আবার এখানেই শেষ নয়। যারা সাহস করে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে থানা পর্যন্ত আসেন, তাদের বেশিরভাগই আদালত পর্যন্ত নিতে পারেনা। দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়া কিংবা এর দীর্ঘসূত্রতার কারনে আসামি পক্ষে থেকে ভিক্টমরা নানা ভাবে হেনস্তার স্বীকার হন। আবার ধর্ষণের বিচার যেন আরেকটি তামাশা। আদালতে ভুক্তভোগী নারীর মুখ থেকে পুনরায় ঘটনা শোনার নামে আরেকদফা যৌনতৃপ্তি অথবা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ধর্ষক খালাস পেয়ে যায়।

তবে ধর্ষণ যেমনি ভাবে বেড়েছে তেমনি সাধারণ জনগণও সচেতন হওয়ার পাশাপাশি এটির শাস্তি বৃদ্ধির জোর দাবি জানাচ্ছেন। কেউ কেউ আমেরিকা, চীন, পোল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, সৌদি, মালেশিয়া, আফগানিস্তানের মতো মেডিকেল পরীক্ষার পর মৃত্যুদন্ড, হিংস্র বুনো শুয়োরের খাঁচায় ফেলে, পাথর ছুড়ে, জনসম্মক্ষে শিরচ্ছেদ, ধর্ষিতার পরিবারের হাত দিয়ে মৃত্যুদন্ডের মতো দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি করছেন।

আবার ধর্ষণ আমাদের দেশে একটি সিস্টেমিটিক ক্রাইমে পরিনত হয়েছে। এক্ষেত্রে স্রেফ ধর্ষক একাই দায়ী নয় তার পিছনে আছে আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া লম্বা একটি লাইন, অধিকাংশ সময়ই তা অদৃশ্য। তাই সবারই উপলব্ধি এটির শাস্তি সর্বোচ্চ হলে ঘটনার সংখ্যা নিশ্চিত কমবে এবং পিছনের লাইনও ছোট হয়ে আসবে। ধর্ষণ প্রতিনিয়ত চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, বিদ্যমান আইন ও এর দুর্বল প্রয়োগনীতি এই দুটি মারাত্মক অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না!

কিছুদিন আগে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বাংলাদেশে শিশু ও নারী ধর্ষণ বন্ধ করতে ধর্ষকদের ক্রসফায়ারে দেয়ার জন্য সরকারী ও বিরোধী দলীয় থেকে যে দাবি উঠেছিল তা আইনপ্রণেতারা ভালোভাবে উপলব্ধি করে বাস্তবায়ন করলে এটির লাগাম টানা সম্ভব বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন পলিসি মেকাদের সময় এসেছে ধর্ষণের মতো একটি মানবতা বিরোধী অপরাধের বিষ বৃক্ষটির লাগাম টেনে ধরার। না হয় সমাজের এই অবক্ষয় মহামারি হিসেবে চিহ্নিত হবে।

বর্তমানে অবিভাবকরা একজন কন্যা সন্তান নিয়ে যতটা চিন্তিত তারচেয়ে বেশি চিন্তিত ছেলে সন্তানের জনক-জননী হয়ে। কারন ছেলেটা যেকোন সময় রেপিস্ট হতে পারে। আর দেশের আইনে শালীন ভাবে চলার প্রতি কিংবা ধর্ষণ বিরোধী সচেতনতা থাকলেও কার্যকরী ধর্ষণ বিরোধী আইন প্রয়োগ হয়না।

সম্প্রতি সময়ে সরকার প্রতারক শাহেদ ও মিন্নির ঘটনায় বিচারবিভাগীয় স্বচ্ছতা বজায় রেখে নিকট অতিতে যে দ্রুততম রায় প্রদান করে সুনাম অর্জন করেছেন তার ধারাবাহিকতায় ধর্ষণের ক্ষেত্রে কঠিন আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি প্রদান করলে সরকারে উন্নয়নের ধারা এবং সুশাসনের ক্ষেত্রে সুনাম বয়ে আনবে বটে।

অন্যথায় সোশাল মিডিয়ায় আঁধার মেখে যে প্রতিবাদ হচ্ছে ধর্ষণ আঁধারের বিরুদ্ধে তা কতটুকু আলো নিয়ে আসবে তা সন্দিহান।

তবে বেগমগঞ্জে দেলোয়ারসহ যে পাঁচজন একজন বিবস্ত্র নারীকে ঘিড়ে পৈশাচিক উল্লাস করছিল, তারা দেখতে মানুষের মতো ছিল; তাই একজন মানুষ হিসেবে আমি বিব্রত!


লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
(nuruddin7654@gmail.com)


সর্বশেষ সংবাদ