আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস

৯ মাসে নির্যাতনের শিকার ৯৯৩ কন্যাশিশু, বেশির ভাগই ধর্ষণ

আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস
আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস  © সংগৃহীত

আজ শনিবার (১১ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালিত হচ্ছে। এ দিনে কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মেয়েদের নেতৃত্বে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এ বছরের দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আমি সেই মেয়ে, আমিই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিই: সংকটের সামনের সারিতে মেয়েরা’।

দেশে কন্যাশিশুর ওপর সহিংসতা ও ধর্ষণ ক্রমবর্ধমান। ফেনী সদর উপজেলার ঘটনায় ছয় বছরের এক কন্যাশিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। শিশুটিকে নিখোঁজ হওয়ায় পরিবার ও স্থানীয়রা খোঁজে মাইকিং করেন। গভীর রাতে ইটভাটার পরিত্যক্ত সেপটিক ট্যাংক থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের তদন্তে মো. রাসেল (১৮) নামের এক শ্রমিককে গ্রেপ্তার করা হয়।

কক্সবাজারের টেকনাফে হ্নীলা ইউনিয়নের পূর্ব পানখালীতে চার বছরের হুজাইফা নুসরাত আফসির হত্যার ঘটনা ঘটে। জন্মদিন ৬ অক্টোবর হলেও শিশুটিকে সেই দিনই দাফন করতে হয়। আফসির লাশ ৫ অক্টোবর বাড়ির লাগোয়া পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। চার ভাই–বোনের মধ্যে তৃতীয় শিশু আফসির হত্যার ঘটনায় বাড়ির মালিকের স্ত্রী ও ছেলে সহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। টেকনাফ মডেল থানার ওসি আবু জায়েদ মো. নাজমুন নূর জানান, আসামিদের মধ্যে দুজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন এবং হত্যার পেছনে সম্ভবত সোনার কানের দুলের লোভ থাকতে পারে।

সরকারি ও বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কন্যাশিশুদের ওপর সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২ হাজার ১৫৯টি শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে। একই সময়ে নারী ও শিশু ধর্ষণের মামলা ২ হাজার ৭৪৪টি। তবে কন্যাশিশুর ধর্ষণের আলাদা তথ্য দেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ৯৯৩টি কন্যাশিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ১৫টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার তথ্য সংকলনে দেখা গেছে, নির্যাতনের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এ সময়ে ৩৫০ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ১৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ৮১ কন্যাশিশু হত্যার শিকার হয়েছে। ধর্ষণচেষ্টা, পাচার, যৌন নিপীড়ন, উত্ত্যক্ত, বাল্যবিবাহসহ নানা ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ৩৯০ কন্যাশিশু ধর্ষণ বা দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ে (২২৪ জন) তুলনায় বেশি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড।

মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ২৩৭ নারী ও কন্যাশিশু বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। শুধু সেপ্টেম্বরেই ২৯ কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, বয়স শূন্য থেকে ১৮ পর্যন্ত।

পিবিআই-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালে ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তদের ২০.২৩ শতাংশ মাদকাসক্ত এবং ২৭.৩৮ শতাংশ পর্নোগ্রাফি আসক্ত। ভুক্তভোগীর ৭২.৬১ শতাংশ শিশু ও শিক্ষার্থী। অনেক ঘটনায় অভিযুক্ত ভুক্তভোগীর আত্মীয় বা পরিচিত। অধিকাংশ ভুক্তভোগী অতি দরিদ্র পরিবারভুক্ত।

পারিবারিক সহিংসতাও কন্যাশিশুর ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। লক্ষ্মীপুরে ছয় বছরের এক কন্যাশিশুকে বাবা কুপিয়ে হত্যা করেছেন। ৯ মাসে পারিবারিক নির্যাতনের পর ৪৭ শিশুর মৃত্যু ঘটেছে, যার মধ্যে ৩৬ জনের বয়স ছয় বছরের কম।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ বছরে কৈশোর বয়সী মেয়েদের জীবনে কিছু অগ্রগতি হলেও বিশ্বের প্রায় সবখানে তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কন্যা ও তরুণীদের শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণে ছেলেদের তুলনায় দ্বিগুণ ঝুঁকি রয়েছে।

মাগুরার ধর্ষণ (পরে মৃত্যু) ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদ-প্রদর্শনের পর শিশু ধর্ষণ মামলার বিচার দ্রুত করার জন্য আইনে সংশোধন আনা হয়। ২৫ মার্চ ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি হয়। এতে শিশু ধর্ষণ মামলার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল, ছেলেশিশুদের বিরুদ্ধে যৌনকর্মকে ‘বলাৎকার’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, ধর্ষণের মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুত করা, বিয়ের প্রলোভনের মাধ্যমে যৌনকর্ম শিরোনামে নতুন ধারা সংযোজন এবং ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ