ছাত্র সংসদ ও ছাত্ররাজনীতি: প্রভাবের দ্বন্দ্ব নাকি সমন্বয়?
- নাদির আহমেদ
- প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৪৮ AM , আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১:৫৪ AM
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও নেতৃত্ব বিকাশে ছাত্র সংসদ ও ছাত্ররাজনীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্যাম্পাস জীবনে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক অনেক সময় সমন্বয়পূর্ণ হলেও, কখনো কখনো দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে না। তাই প্রশ্ন আসে—ছাত্র সংসদ এবং ছাত্ররাজনীতি কি একে অপরকে প্রভাবিত করছে, নাকি তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে? এ দ্বন্দ্বের বাস্তবতা এবং সমন্বয়ের সম্ভাবনা শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশ ও ক্যাম্পাসের শান্তি দুইয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। এটি শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সুরক্ষা, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং প্রশাসনের সঙ্গে সংযোগের দায়িত্ব পালন করে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সংসদ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্ব, দায়িত্ববোধ এবং সমঝোতার দক্ষতা গড়ে তোলে। ছাত্র সংসদ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক মনোভাব সৃষ্টি করে এবং ক্যাম্পাসে সমন্বিত ও সুশৃঙ্খল পরিবেশ নিশ্চিত করে। এটি শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নৈতিক নেতৃত্ব এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ বিকাশে সহায়ক।
অপরদিকে, ছাত্ররাজনীতি রাজনৈতিক দল ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সংসদকে অনেক সময় প্রভাবিত করে। ইতিহাস প্রমাণ করে যে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের শক্তি এবং নেতৃত্ব বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তবে ইতিহাস এটাও প্রমাণ করে, রাজনৈতিক প্রভাব সংসদের কার্যক্রমে কখনো কখনো দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতার লড়াই প্রায়শই সাধারণ শিক্ষার্থীর স্বার্থকে প্রভাবিত করে। এর ফলে ছাত্র সংসদের কার্যকারিতা হ্রাস পায়, ক্যাম্পাসে বিভাজন এবং সহিংসতার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, এবং শিক্ষার্থীর আস্থা ক্ষুণ্ন হয়।
বাস্তবতায় দেখা যায়, নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে শিক্ষার্থীর স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। এটি শুধু নেতৃত্ব বিকাশে বাধা দেয় না, বরং শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা ও অংশগ্রহণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ক্যাম্পাসে দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অর্জনে ব্যর্থ হয়, যা দীর্ঘমেয়াদি নেতৃস্থানীয় সক্ষমতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বিকাশকে ব্যাহত করে।
যেখানে দ্বন্দ্ব থাকে, সেখানে সমন্বয়ও সম্ভব। নির্বাচন সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ হলে, রাজনৈতিক প্রভাব সীমিত রাখা হলে এবং শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করে, ছাত্র সংসদ ও ছাত্ররাজনীতি একে অপরের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে। সমন্বয় নিশ্চিত হলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনার সংস্কৃতি, যুক্তি-তর্কের চর্চা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ হয়। ছাত্র সংসদ ও ছাত্ররাজনীতি একে অপরের প্রতি সমন্বয়মূলক মনোভাব গ্রহণ করলে ক্যাম্পাসে নেতৃত্বের বিকাশ এবং শিক্ষার্থীর সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
দ্বন্দ্ব এবং সমন্বয়—দুটোর মধ্যেই শিক্ষার্থীর নেতৃত্ব গঠনের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। প্রাসঙ্গিক ও সুশৃঙ্খল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন সম্পন্ন করা, দলীয় প্রভাব সীমিত রাখা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা বজায় রাখা গেলে সংসদ ও রাজনীতি উভয়ই শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কার্যকর হতে পারে। শিক্ষার্থীদের সচেতন অংশগ্রহণ ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
ছাত্র সংসদ ও ছাত্ররাজনীতি পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। দ্বন্দ্ব থাকলেও তা সমাধানযোগ্য, এবং সমন্বয় থাকলে তা শক্তিশালী। দায়িত্বশীল নেতৃত্ব, সচেতন অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক প্রভাবের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করলে এরা কেবল দ্বন্দ্বের জায়গা নয়, শিক্ষার্থীর নেতৃত্ব বিকাশ এবং সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সমন্বিত ও সুশৃঙ্খল ছাত্ররাজনীতি ক্যাম্পাসকে শিক্ষার সঠিক গতি দিতে পারে এবং নতুন প্রজন্মকে দায়িত্বশীল ও সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হয়।
আজকের শিক্ষার্থী সমাজের জন্য ছাত্র সংসদ ও ছাত্ররাজনীতির মধ্যে সমন্বয়, দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এবং সচেতন অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এটি শুধু রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতিযোগিতা নয়, বরং শিক্ষার্থীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং নেতৃত্ব গঠনের প্ল্যাটফর্ম। সঠিক দিকনির্দেশনা এবং দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে দ্বন্দ্বকে সমাধান এবং সমন্বয়কে শক্তিশালী করে ছাত্র সংসদ ও ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের জন্য এক সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে।
অতএব, ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক পরিবেশ শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষণীয় শিক্ষার জায়গা হয়ে উঠতে পারে, যদি সংসদ এবং রাজনীতি সমন্বয় পূর্ণভাবে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব দায়িত্ববোধ, যুক্তি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হলে, দ্বন্দ্বকে সমাধান এবং সমন্বয়কে শক্তিশালী করে ছাত্র সংসদ ও ছাত্ররাজনীতি কেবল নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্র নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা, নৈতিক নেতৃত্ব এবং মুক্ত চিন্তাভাবনা বিকাশে সহায়ক হয়ে ওঠে।
লেখক, শিক্ষার্থী সমাজকর্ম বিভাগ, শাবিপ্রবি।