স্বৈরাচার এরশাদ থেকে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা 

সাইদুর রহমান
সাইদুর রহমান  © টিডিসি সম্পাদিত

স্বৈরাচার এইচএম এরশাদ আর পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা মিলে ২৯টি বছর বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিয়েছে। ৫৪ বছর বয়সী দেশের ২৯টি বছরই দুই স্বৈরাচার শাসন করে গেছেন। এরশাদের নয় বছরের শাসনামল, শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০২৪ শাসনকাল সব মিলিয়ে এই ২৯টি বছর রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করেছিল জনগণ কর্তৃক স্বীকৃত দুই স্বৈরাচার। 

রাজনৈতিক অঙ্গনে এরশাদ এবং হাসিনাকে ভাই-বোন বলে সম্বোধন করা হয়। এরশাদকে স্বৈরাচার হতে সহযোগী ছিলেন হাসিনা। তেমনি হাসিনাকে চূড়ান্ত স্বৈরাচার হতে সহযোগিতা করেছিলেন এরশাদ। দুই ভাই-বোন এ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিয়েছেন। পাক হানাদার বাহিনীর মতো জনগণকে নির্যাতন, নিপীড়ন করেছেন। হয়েছেন জনধিকৃত। 

১৯৮৬ সালের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদ-হাসিনার লং ড্রাইভ রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো আলোচনার খোরাক জোগাই। সেই লং ড্রাইভের পর এরশাদের অধীন নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। এরশাদ ক্ষমতায় আর বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। এই নির্বাচনে আবার অংশ নিয়ে যথারীতি বলির পাঠা হয়েছিলো জামায়াত। রাজপথে প্রতিবাদে আন্দোলরত বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচন আয়োজনে অন্যতম সহযোগী ছিল জাপা। শেখ হাসিনা-এরশাদ মিলে একতরফা ভোটে গঠিত সরকার পরিচালনা করে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাতের ভোটে যথারীতি হাসিনার সঙ্গী সেই এরশাদের জাপা। তেমনিভাবে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ভোটে হাসিনাকে বেপরোয়া হতে চূড়ান্ত সহযোগিতা করে জাপা।

হাসিনা-এরশাদের ২৯ বছরের মধ্যে ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৩ কিছুটা বাকস্বাধীনতা ছিল। নিম্নসূচকের গণতন্ত্রে ছিল দেশ। তবে ১৯৯৬-২০০১ জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমান, আবুল হাসনাত, এইচ এম ইকবালের মতো সন্ত্রাসীদের জন্ম দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। হাসিনা আর এরশাদ দুইজন প্রচন্ড ক্ষমতালোভী ছিলেন। রাষ্ট্রের চেয়ে অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রচন্ড।

আওয়ামী লীগ এবং জাপাকে স্বৈরাচারের জন্য কিছুটা হলেও দায়ী জামায়াতে ইসলামী। বাংলাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অগ্রসর হতে ব্যর্থ দলটির কারণে জনগণকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, জাপাকে সাথে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতের যুগপৎ আন্দোলন রাজনীতিতে হাসিনা-এরশাদকে পুনর্বাসন করেছিল। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের জন্মের বিরোধীতার বিষয়ে দলটির অবস্থান এখনো স্পষ্ট করা হয়নি।

১৯৯৬ সালে জামায়াত কর্তৃক পুনর্বাসিত আওয়ামী লীগ-জাপা পরবর্তীতে দেশটার বারোটা বাজিয়েছে। সেই সময় আওয়ামী লীগের সাথে জাপা এবং জামায়াতের এমপিরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আন্দোলনে নামে দেশকে অচল করে দিয়েছিল। পরবর্তীতে দুই ভাই-বোনের কেরামতিতে নিবন্ধন হারিয়েছে জামায়াত। মামলা, হামলা, গুম, খুনের পাশাপাশি চরম নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতকেও। দুই ভাই-বোনের যৌথ প্রযোজনায় বাকরুদ্ধ করা হয়েছিল জনগণকে। দুই পতিত স্বৈরাচারের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। তবে এখনো পুরোপুরি মুক্ত হয়নি জনগণ। স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসনের কারণে শঙ্কিত দেশপ্রেমিক জনগণ। ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসিত হচ্ছে রাজনৈতিক দলেও। 

জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর জনগণের প্রত্যাশা নতুন বাংলাদেশের। প্রত্যাশিত বাংলাদেশে চাওয়া বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বির্নিমান, সুশাসন, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার নিমিত্তে দেশকে এগিয়ে নেয়া। নতুন কোন রাজনৈতিক দলকে ফ্যাসিবাদে রুপান্তর হতে না দেয়া, রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কল্যাণে জনমুখী রাজনীতি করা। ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদের অবিলম্বে বিচার কার্যক্রম শুরু করে দোষীদের বিচার নিশ্চিত করা। জনগণের প্রত্যাশা ভোট বঞ্চিত মানুষকে নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটদানের ব্যবস্থা করা। জনগণ ভোটে দিতে উন্মুখ হয়ে আছেন। নতুন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করতে অধীর আগ্রহ অপেক্ষায় জনগণ। তাদের চাওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন সরকারের যাত্রা। 

আগামীতে যারাই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবে সেই দলের উচিত হবে ১৯৭১ সালের আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার এরশাদের পতনে গণঅভ্যুত্থান, ২০০৭ সালের বিগত ওয়ান-ইলেভেন, ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবকে ধারণ করে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেয়া। আরো উচিত হবে আগামীতে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে নতুন রাজনীতির বন্দোবস্ত করা। 

লেখক: রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক।


সর্বশেষ সংবাদ