বুলেটের আঘাতে থেমে গেল রিকশাচালক জসিমের স্বপ্ন

গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ রিকশাচালক—মো. জসিম উদ্দিন সরকার
গণঅভ্যুত্থানে নিহত শহীদ রিকশাচালক—মো. জসিম উদ্দিন সরকার  © টিডিসি সম্পাদিত

২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই-আগস্ট। বৈষম্যের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে ছাত্র-জনতা, আর রাজধানী ঢাকার রাজপথে গড়ে উঠছে এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন। কোথাও টিয়ারশেল, কোথাও জলকামান—তবুও দমে যায়নি তরুণদের মিছিল। এই উত্তাল আন্দোলনের ঠিক মাঝখানে, জীবন হারান এক নীরব সংগ্রামী, একজন খেটে খাওয়া রিকশাচালক—মো. জসিম উদ্দিন সরকার।

জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার নয়ানগর গ্রামের সন্তান ছিলেন জসিম। ১৯৮৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীর আলম খোরা ও আছিয়া বেগমের ঘরে জন্ম নেওয়া এই তরুণ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন নিরহঙ্কার, পরিশ্রমী ও পরিবারের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। সংসারের অভাব-অনটনের মধ্যেও মেধাবী ছাত্র হিসেবে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই তিনি পরিচিত ছিলেন শিক্ষক-সহপাঠীদের কাছে। কিন্তু দারিদ্র্যর শেকল তাকে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করতে দেয়নি। জীবিকার তাগিদে একসময় ঢাকায় পাড়ি জমান, হয়ে ওঠেন একজন রিকশাচালক। তাতে কোনো লজ্জা ছিল না তাঁর, কারণ পরিবার চালানোর দায় ছিল তার কাঁধে।

প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে যা আয় হতো, তা দিয়েই চলত পরিবারের খরচ। ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত হয়রানি, পুলিশের বটমূলে দুর্ব্যবহার, এমনকি রাস্তায় চলাচলেও বাধা—এসব ছিল তার নিত্যদিনের বাস্তবতা। কিন্তু নিজের সৎ উপার্জনে তিনি কখনো হাল ছাড়েননি।

২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার ও শাসনব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন। জসিম কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু এ আন্দোলনের যে নৈতিকতা, যে প্রশ্নগুলো রাস্তায় উচ্চারিত হচ্ছিল—সেগুলো ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁকেও। কারণ তার জীবনও ছিল রাষ্ট্রীয় বৈষম্য আর অবহেলার শিকার।

৪ আগস্ট ২০২৪ বিকাল ৪টার দিকে রাজধানীর শাপলা চত্বরে একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে আচমকা পুলিশ গুলি চালায়। আন্দোলনের ভিড়ে জসিমও ছিলেন সেদিন। নিজের কর্মস্থলেই ছিলেন, হয়তো যাত্রী খুঁজছিলেন কিংবা দাঁড়িয়ে স্লোগান শুনছিলেন। ঠিক সেই সময়, গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। একটি গুলি এসে বিদ্ধ করে তাকে। গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। এরপর শুরু হয় মৃত্যুর সঙ্গে ১০ দিনের এক দীর্ঘ লড়াই। ১৪ আগস্ট সকাল ১১টা ২০ মিনিটে সব চেষ্টা থেমে যায়। জীবনযুদ্ধে অসীম পরিশ্রম করা এক মানুষ হারিয়ে যান ইতিহাসের পাতায়। ডাক্তারদের সনদে লেখা হয়: ‘Primary cause of death: Firearm injury.’

জসিমের মৃত্যুতে মেলান্দহের নয়ানগর গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার মা আছিয়া বেগম ছেলের লাশ জড়িয়ে ধরে বারবার বলেন, ‘আমার ছেলেটা কারও ক্ষতি করতো না। দিনরাত রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতো। ওকে কেন মেরে ফেললো?’

গ্রামের মানুষজনও স্তব্ধ। সবাই বলেন, ‘জসিম ছিল সৎ আর পরিশ্রমী। তার মতো লোক তো কমই হয়।’

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।


সর্বশেষ সংবাদ