ফোনের ছবিতে বাবাকে খোঁজে ছাত্রদল নেতা আরিফুলের ২ বছরের মেয়ে

ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল রহমান
ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল রহমান  © টিডিসি সম্পাদিত

দুই বছরের শিশু ফাতিমা রহমান রাইস এখনো ঠিক বোঝে না, ‘বাবা’ শব্দের মানে কী। তবে প্রতিদিন বাবার কবরের পাশে গিয়ে বারবার বলে— ‘বাবা আসো, বাবা আসো।’ এর উত্তর দিতে পারেন না কেউ। কারণ, বাবা মো. আরিফুল রহমান রাসেল এখন শহীদের কবরের নিচে শুয়ে আছেন—৫ আগস্টের সেই রক্তাক্ত বিকেলেই জীবন শেষ হয়ে গেছে তার।

ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল রহমান রাসেল (৩৩) সেদিন গুলিবিদ্ধ হন সাভারের মুক্তির মোড় এলাকায়। সাভার থানার স্ট্যান্ডসংলগ্ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ গুলির মুখে পড়েন। একটি গুলি ডান বাহুর এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আরেকটি গুলি লাগে তার মেরুদণ্ডে। শরীর থেকে প্রবল রক্তক্ষরণ শুরু হয়। তাকে সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকারীরা সাভার ইনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার আইসিইউতে নেওয়ার ২০ মিনিটের মাথায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুধল ইউনিয়নের সুন্দরকাঠী গ্রামের সন্তান রাসেল। মৃত্যুর পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়িতে। সেখানে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার স্ত্রী মোসা. সোনিয়া আক্তার বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করছেন। ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তাদের বিয়ে হয়। সংসারে কেবল দেড় বছরের একমাত্র কন্যাসন্তান ফাতিমা।

আরও পড়ুন: আঁটকে পড়াদের উদ্ধারে গিয়ে নিজের প্রাণই দিলেন আলামিন

স্ত্রী সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘৪ আগস্ট মিরপুর গাবতলীতে আন্দোলনে গিয়েছিলেন। সেইদিনই ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরেন। পরদিন ৫ আগস্ট আমি তাকে বারবার অনুরোধ করি, বাইরে না যেতে। কান্নাকাটি করি। কিন্তু সে আমায় ধাক্কা দিয়ে জুতা ছাড়াই বেরিয়ে গেল। এটাই ওনার সাথে আমার শেষ কথা।’

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র ফোন দিয়ে জানায় ওনার অবস্থা খারাপ। আমি ছুটে যাই সাভার ইনাম হাসপাতালে। তখনো প্রাথমিক চিকিৎসাও শুরু হয়নি। আমি ওনার জন্য হসপিটালের লোকদের পায়ে ধরে অনুরোধ করেছি। তারা ওষুধ আনতে বলেছে, ভর্তি করতে বলেছে—তবে চিকিৎসা শুরু করেনি। এই সময় রক্তে ভেসে যাচ্ছিল ওনার শরীর।’

তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে ওনার মুখে হাত দিলে রাসেল ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত হাত বুলিয়ে দেন, আমাকেও ধরেন। তারপর তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগেই তিনি নিথর হয়ে যান।’

আরও পড়ুন: ‘হাসিনার পতন ঘটাইয়া বাড়িত আইয়াম— আইল ঠিকই, কিন্তু লাশ হইয়া’

শহীদ রাসেলের স্ত্রী বলেন, ‘তার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে ধানমন্ডিতে বড় স্কুলে ভর্তি করাবেন। তাই ধানমন্ডিতে বাসা নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল আমাদের। ‘আমার স্বপ্ন ছিল নতুন বাসা, তার স্বপ্ন ছিল বড় নেতা হওয়া’। তিনি বড় রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছিলেন। এখন সে স্বপ্ন মাটি হয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার হাসব্যান্ড জীবনে কখনো আমাকে ‘তুই’ বলেনি, উচ্চস্বরে কথা বলেনি। সাত মাস আমি হাসপাতালে ছিলাম, তিনি একদিনও বাড়ি যাননি। এমন মানুষ ছিল সে। আজ সে নেই। আমি এখনো সেই ধাক্কার দৃশ্য ভুলতে পারি না।’

তিনি জানান, ‘একদিন আমার ভাইয়ের পায়ে জুতা দেখে মেয়েটি বলে উঠল, ‘বাবা ভালো আছ?’ ভেবেছিল ওর বাবা এসেছে। আবার বাবার ছবি মোবাইলে দেখলেই বলে, ‘আমার বাবা চাই, আমার বাবা চাই।’ আমি কীভাবে বোঝাই, ওর বাবা আর কখনো আসবে না!’

সোনিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। ইউনুস সরকার কিছুই করেনি। এখনো বিচার হয়নি। বৈষম্য তো তেমনি আছে। আমার মেয়ে বড় হয়ে যদি জানতে চায়, “আমার বাবার বিচার কোথায়?” আমি কী বলব? আমার ওপর সেই বোঝা রয়ে গেল।’

শহীদ রাসেলের মা রিনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে কখনো উচ্চস্বরে কথা বলেনি। খুব শান্ত ছেলে ছিল। এখনো দিনরাত কাঁদি। বুকের ভেতরটা পুড়ে যায়। ছেলের রক্তমাখা ছবি দেখাই, আবার কান্না চাপি।’

আরও পড়ুন: ‘আশা ছিল ছেলেকে সাদা অ্যাপ্রোনে দেখব, দেখলাম সাদা কাফনে’

বাবা খলিলুর রহমান বলেন, ‘গত রমজানে আমার পা ভেঙেছিল। বিছানায় শুয়ে কেবল একটিই কথা মনে পড়ে—আমার সেই ভালো ছেলেটা, আর ফিরে আসবে না।’

আরিফুল রহমান রাসেল ১ জানুয়ারি ১৯৯১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। হাজেরা খাতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু, এরপর বরিশাল ইসলামিয়া হোসাইনিয়া মাদ্রাসায় হাফেজি পড়া, বাঘিয়া আল-আমিন কামিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিম পাশ করেন। পরবর্তীতে বিএম কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে চাকরি করেন। এরপর নিজেই ‘তালুকদার ফার্মেসি’ চালু করেন, পরে সেটি বন্ধ করে সাভার পপুলার মেডিকেলে চাকরি নেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিএনপির ঢাকা মহানগর পূর্বের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ৫ আগস্ট দেওগাঁও বাজার থেকে মিছিল নিয়ে মুক্তির মোড়ে গেলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন শহীদ আরিফুল।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপিড়ীন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাছিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।


সর্বশেষ সংবাদ