‘বাংলাদেশিদের বেশি মনোযোগ টাকা আয়ে, নিজের দিকে নয়’

সাঈদ গজানফর আহম্মদী
সাঈদ গজানফর আহম্মদী  © টিডিসি ফটো

আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশে পড়তে এসেছেন সাঈদ গজানফর আহম্মদী। তিনি বর্তমানে ওআইসির সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (আইইউটি) পড়াশোনা করছেন। আফগানিস্তানে সাঈদের বেড়ে ওঠা, স্কলারশিপ নিয়ে বাংলাদেশে পড়তে আসা এবং দুই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তার কথাগুলো শুনেছেন আইইউটি প্রতিনিধি তাওফিকুল ইসলাম হিমেল

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি কেমন আছেন? আইইউটিতে আপনাকে স্বাগতম
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার পরিচয়, শৈশব সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: আমি সাঈদ গজানফর আহম্মদী। লোকে আমাকে গাজো বলে ডাকে। কিন্তু বাংলাদেশে মানুষ আমাকে গাজা, গাঞ্জা বা গজুর বলে।

আমি ২০০১ সালে আফগানিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছি। তারপর সেখানেই বেড়ে উঠি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক পড়াশোনাও আমার সেখানে। শিক্ষাজীবনে ২০১২ সালে ইরানে অনুষ্ঠিত এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে গণিত প্রতিযোগিতার জন্য আফগানিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে পাঁচজন শিক্ষার্থীকে নির্বাচিত করা হয়; যার মধ্যে আমিও একজন ছিলাম।

২০১৭ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার পর (আফগানিস্তানে উচ্চমাধ্যমিক পড়তে হয় না) আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি শুরু করি। এক বছর প্রস্তুতির পর আমি কাবুল পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য প্রকৌশলের বিভাগে সম্পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হই। আমি কাবুল পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ সেমিস্টার অধ্যয়নও করেছি। এরপর আইইউটিতে স্কলারশিপের আবেদন করে মনোনিত হই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশে কীভাবে এলেন
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: ২০১৯ সালে আমি আফগানিস্তানের তিনজন ছাত্রের মধ্যে একজন, যারা আইইউটি থেকে সম্পূর্ণ বৃত্তি পেয়েছিল। বাংলাদেশে এসে মানুষ ও পরিবেশ দেখে নিশ্চিত হলাম যে এটা এমন জায়গা নয় যা আমি শুনেছিলাম এবং আশা করেছিলাম।

আরও পড়ুন: ক্যামেরুনে মেডিকেল ছেড়ে বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছি

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আইইউটি আপনার কাছে কেমন লাগে
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: আমি যখন প্রথম আইইউটিতে ক্লাসে যেতে শুরু করি; শুরুর ক্লাসগুলো আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর ছিল। আমি এই ধরনের শিক্ষকের ইংরেজি উচ্চারণের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। এছাড়াও ঢাকার সংস্কৃতি, খাদ্য, আবহাওয়া এবং ট্রাফিক জ্যাম আমার আইইউটি জীবনকে কঠিন থেকে কঠিন করে তুলেছে। কিন্তু আমি কখনই হাল ছাড়িনি এবং আমার কাছে অন্য কোনো বিকল্পও নেই। আমি সত্যিই আমার পরিবার, বন্ধু এবং আমার দেশকে মিস করছি।

আমি আইইউটিতে বর্তমানে সিএসই বিভাগে তৃতীয় বর্ষে রয়েছি। এ বিভাগের পড়াগুলো আমার জন্য খুব কঠিন বলা যায়। কারণ আমার ক্ষেত্রে এবং এ বিষয় সম্পর্কে আমার প্রাথমিক ধারণাও ছিল না। এখানে এখন ধীরে ধীরে সবকিছুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছি। আমি সামাজিকভাবে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চাই। আমার দেশেও আমি তাই করেছি। এখন আইইউটিতেও একই কাজ করছি। এখানের শিক্ষার্থীদের আচরণও অনেক ভালো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্তার পার্থক্য কী
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: আফগানিস্তান আর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার তেমন পার্থক্য নেই। আফগানিস্তানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন শিক্ষক ছাত্রকে পূর্ণ আবেগ ও সেরাটা দিয়ে শেখান; এখানেও আমি সেটি দেখেছি। তবে বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ ও স্থাপত্য অনেক ভালো। কিন্তু আবার প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, সুবিধা এবং বিশেষ করে কলেজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশকে ঘরের মাঠ বানাতে চায় আফগানিস্তান

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশে যেমন বিসিএস পাসের মাধ্যমে প্রার্থী সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করে; আফগানিস্তানে এটি কোন পদ্ধতিতে করা হয়
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: সিভিল সার্ভিস সম্পর্কে বাংলাদেশ একটি আশ্চর্যজনক দেশ। কিন্তু আফগানিস্তান এখন তালেবানদের কারণে সবকিছুই খুব খারাপ যাচ্ছে এবং প্রায় নিয়োগ শূন্য অবস্থা। তবে পূর্ববর্তী সরকারি সিভিল সার্ভিসের নিয়োগে বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন ছিল। অর্থাৎ আফগানিস্তানের চাকরি প্রার্থীদের বাংলাদেশের মতো এতো কঠিন পদ্ধতির মধ্যদিয়ে যেতে হয় না, আগের সরকারগুলোর সময়ে এখানে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল। এছাড়া আফগানিস্তান বাংলাদেশের চেয়ে ৫ ‍গুণ বড় এবং এর জনসংখ্যাও বাংলাদেশের চেয়ে ৪ গুণ কম।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশের কোন বিষয়টি আপনার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: আফগানিস্তানে থাকতেও আমি সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে চলাফেরা করতাম। এই অভ্যাসটি আমাকে বাংলাদেশের জীবনযাপন সাহায্য করছে। এখানে আমার আশেপাশের মানুষগুলোও বন্ধুত্বপূর্ণ।

আমি বাংলাদেশি মানুষ, সংস্কৃতি, খাবার এবং আবহাওয়া পছন্দ করি। বাংলাদেশে এমন একটি সুন্দর জায়গা যে আমি আমার দেশের লোকেদের এটি ভ্রমনের পরামর্শ দিচ্ছি। এখন আমি ইম্পালস এফসি (আইইউটি ফুটবল দল), আইইউটি ভলিবল দলে আছি এবং বাইরের কিছু স্থানীয় ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেলছি। আইইউটির বাইরের লোকেরা আশ্চর্যজনক, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং অতিথিপরায়ণ। বাংলাদেশের বৃষ্টিপাতের আবহাওয়া, পর্যটন স্থান, মানুষের ঐক্য এবং মানুষের প্রচেষ্টা আমার ভালো লাগে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অবসর সময় কীভাবে কাটান
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: আমি ফুটবল, ভলিবল, গেম খেলা, ফটোগ্রাফি, গ্রাফিক এবং সঙ্গীত পছন্দ করি। আমার অবসর সময়গুলো আমি এই শখগুলো থেকে উপভোগ করি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশের কোন বিষয়গুলো আপনার অপছন্দ
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: এখানের কিছু মুসলিম যারা ধর্ম পালনের নামে অভিনয় করেন। অনেকে ইউরোপের উগ্র সংস্কৃতির চর্চা করেন। আবার অনেকের মধ্যে মৃত্যুর পরের চিন্তা কম; তাদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ গাড়ি কেনা বা টাকা আয়ের দিকে, তারা তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পোশাক এবং নিজের জন্য অর্থ ব্যয় করেন না।

বাসে নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রতি মানুষের অসম্মান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সিনিয়র এবং জুনিয়র পার্থক্য না মানা- বাংলাদেশের এসব ব্যাপারগুলো আমার অপছন্দ। যদিও আইইউটিতে এই বিষয়টি কম দেখা যায়। এই জিনিসগুলো আফগানিস্তানেও নেই।

আরও পড়ুন: আফগানিস্তান পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: তালেবান নিয়ে আপনার মন্তব্য কি
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: তালেবানরা ইসলামের অন্যতম বিপজ্জনক শত্রু, যারা মুসলিম হিসেবে কাজ করছে। তারা ইসলামকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। তারা সব হারাম কাজ করছে এবং ইসলামের নাম নিয়ে করছে। এই ২১ বছরে তারা হাসপাতাল, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাস্তাঘাটে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে হাজার হাজার ছাত্র, শিশু, মা, সাধারণ শ্রমিক এবং আমাদের সৈনিকদের হত্যা করেছে।

কেউ তাদের বিশ্বাস করবে না এবং ক্ষমাও করবে না। এখন তারা সরকারি চাকরি থেকে শিক্ষিত লোকদের বের করে দিচ্ছে এবং তাদের অশিক্ষিত লোকদের সে পদগুলোতে নিয়োগ দিচ্ছে; যারা পাহাড় থেকে এসেছে, তারা পড়তে-লিখতে পারে না। 
সৈনিক নিয়োগও এভাবে হচ্ছে। তারা মেয়েদের জন্য স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে এবং মেয়েদের জন্য সব কিছু নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে। এমনকি অনেক সময় মেয়েরা বাড়ির বাইরেও যেতে পারছে না। বাংলাদেশের যে জনগন তালেবান নিয়ে অন্ধ বিশ্বাস করে তারা তালেবান সম্পর্কে কিছুই জানেন না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি যখন দেশে ছিলেন, তখন অবশ্য তালেবান সরকারে ছিলেন না। আফগানিস্তানে কোন সরকার বেশি জনবান্ধব?
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: আমি তালেবানের আসল চেহারার কথা উল্লেখ করেছি। তারা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ, একেবারে আগের সরকারের মতোই সবাই। আপনি কীভাবে তালেবানদের পছন্দ করবেন? এমন লোকের কাছ থেকে আর কি আশা করেন যারা আফগানিস্তানের প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজনকে হত্যা করেছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: আমি স্নাতক শেষ করে আফগানিস্তানে যাব। আমার বেলজিয়াম বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে যাওয়ারও সুযোগ রয়েছে, কারণ আমার ভাইয়েরা সেখানে আছেন। কিন্তু আমি যাব না, কারণ আমি আফগানিস্তান পছন্দ করি এবং আমি আমার দেশের জনগণের জন্য কাজ করতে চাই। আমি আফগানিস্তানের জন্য অন্তত ১% পরিবর্তন আনতে পারব বলে বিশ্বাস করি। আমার মা আফগানিস্তানে আছেন; আমি তার জন্য এটা করতে চাই। আমার মায়ের সুখের চেয়ে বড় কিছু নেই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
সাঈদ গজানফর আহম্মদী: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্যেও শুভকামনা।


সর্বশেষ সংবাদ