দেশের হাসপাতালের আইসিইউ
৪১ শতাংশ রোগীর শরীরে কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক, এএমআর বাড়ছে বিপজ্জনক হারে
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৪ PM , আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৪ PM
দেশের হাসপাতালগুলোর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি রোগীদের ৪১ শতাংশের শরীরে এখন আর কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না বলে জানিয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)। দেশে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ ক্ষমতা (এএমআর) বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে দিন দিন এই সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআর সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাজধানীর মহাখালীতে এক অনুষ্ঠানে ‘ন্যাশনাল এএমআর সার্ভেলেন্স রিপোর্ট ২০২৫’ প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ড. জাকির হোসেন হাবিব।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানার জন্য ২০২৪ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত দেশের ৯৬ হাজার ৪৭৭ জন রোগীর নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। আইসিইউর পাঁচটি প্যাথোজেনের জন্য ৭১টি অ্যান্টিবায়োটিক পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫টি অ্যান্টিবায়োটিকের সংবেদনশীলতা ৮০ শতাংশের ওপরে। একটির সংবেদনশীলতা ৬০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে। বাকিগুলোর সংবিদনশীলতা ৬০ শতাংশের নিচে।
অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অণুজীব প্যান ড্রাগ রেজিট্যান্স (পিডিআর) সব রোগীর ক্ষেত্রে ৭ শতাংশ এবং আইসিইউর রোগীদের ক্ষেত্রে পিডিআরের উপস্থিতি ৪১ শতাংশ। অর্থাৎ আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীদের ৪১ শতাংশের ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ কাজ করছে না। এগুলোকে মূলত তিনটি ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। এগুলো হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের সংক্রমণের জন্য ‘অ্যাক্সেস গ্রুপ’, উচ্চ সহনশীল ব্যাকটেরিয়ার জন্য ‘ওয়াচ গ্রুপ’ এবং সব বিকল্প ব্যর্থ হলে ‘রিজার্ভ গ্রুপ’।
এছাড়া, উচ্চ সহনশীল ব্যাকটেরিয়ার জন্য ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার আগের বছরের তুলনায় বেড়ে ৭৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৯০.৯ শতাংশ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক হলো সেফট্রিয়াক্সোন (৩৩ শতাংশ), মেরোপেনেম (১৬ শতাংশ), সেফিক্সিম, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, অ্যামোক্সিসিলিন, মেট্রোনিডাজল, ক্লক্সাসিলিন, পাইপেরাসিলিন-টাজোব্যাকটাম ও ভ্যানকোমাইসিন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলোর অযথা ব্যবহারের ফলে কার্যকারিতা দ্রুত কমে যাচ্ছ।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রফেসর ড. জাকির হোসেন হাবিব জানান, অ্যান্টিবায়োটিকের নিয়মহীন ও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সকে (এএমআর) এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে আসার আগেই বেশির ভাগ রোগী ওয়াচ গ্রুপের ওষুধ সেবন করছে। এতে চিকিৎসকরা গুরুতর পরিস্থিতিতে রোগীকে দেওয়ার মতো ওষুধ পাচ্ছে না। তখন রোগীকে বাঁচাতে গিয়ে যে অ্যান্টিবায়োটিক লিখছেন, এতে রোগী বেঁচে গেলেও বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। সবাইকে দায়িত্বশীলভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমিয়ে নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। সাধারণ সংক্রমণও যদি চিকিৎসায় সাড়া না দেয়, তাহলে দেশ ‘পোস্ট-অ্যান্টিবায়োটিক যুগের’ ঝুঁকিতে পড়বে।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, এই পর্যবেক্ষণ থেকে যে বার্তা পাওয়া গেছে, তা হচ্ছে পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর অকার্যকর হওয়ার প্রবণতা কমানো যায়নি। এমনকি সেটি বন্ধ করাও যাচ্ছে না, বরং বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা জরুরি। অর্থাৎ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া কেউ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করবে না।
তিনি আরও বলেন, সাধারণ ঠান্ডা-জ্বর বা ভাইরাল ইনফেকশনের ক্ষেত্রেও অনেকে অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন, যা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় এবং এ সংকটকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
আরও পড়ুন: ৪ তলা বাড়িয়ে হয়েছে সাত, ‘অতি ঝুঁকি’ নিয়েই মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বাস এই ভবনে
জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার পেছনে ছয়টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের প্রেসক্রিপশন, কোর্স সম্পন্ন না করা, পশুপাখির ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে দুর্বল সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধির অভাব, নতুন করে অ্যান্টিবায়োটিক না আসা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. মঈনুল আহসান বলেন, সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় অনেক রোগী হাসপাতালে নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগের তুলনায় হাসপাতালে সংক্রমণ কিছুটা কমেছে, তবু প্রতিরোধ ব্যবস্থা আরো শক্তিশালী করতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. শেখ ছাইদুল হক বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধ করা কোনো ব্যক্তি বা একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এটি খুবই জটিল কাজ। প্রশাসনিক তদারকি আরো বাড়াতে হবে এবং সবাইকে সচেতন হতে হবে। সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা মিলেই সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, প্রেসক্রিপশন গাইডলাইন না মানা, অকার্যকর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ নীতি এবং ল্যাব-সামর্থ্যের ঘাটতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে। এখনই অ্যান্টিবায়োটিক স্টুয়ার্ডশিপ জোরদার না হলে সাধারণ সংক্রমণেও জীবনহানি বাড়বে।
সেমিনারে স্বাস্থ্য খাতের নীতি-নির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন এবং জাতীয় পর্যায়ে দ্রুত নীতিগত পদক্ষেপের আহ্বান জানান।