নবজাতকদের আইসিইউতে ওষুধপ্রতিরোধী ছত্রাকের সংক্রমণ, আক্রান্তদের ৮১% সিজারিয়ান শিশু

নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (এনআইসিইউ)
নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (এনআইসিইউ)  © সংগৃহীত

বালাদেশে নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ছড়িয়ে পড়েছে সুপারবাগ ছত্রাক ক্যান্ডিডা অরিস। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৭৪ জন নবজাতক শিশুর মধ্যে ৩২ জন এ ছত্রাকে সংক্রমিত হয়েছে, যা প্রায় ৯ শতাংশ। এ ছাড়া আক্রান্তদের ৭ জনের মৃত্যু হয়। গবেষকরা বলছেন, দীর্ঘসময় হাসপাতালে টিকে থাকা, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং উচ্চ মৃত্যুহার সৃষ্টির কারণে এ ধরনের ছত্রাককে ‘সুপারবাগ বলা হয়। এরা ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠায় গুরুতর হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

আইসিডিডিআর,বি বলছে, শুধু বাংলাদেশই নয়, স্বাস্থ্যসেবা-সম্পর্কিত সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। এই ধরনের সংক্রমণের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ক্যান্ডিডা অরিস ছত্রাক ছড়িয়ে পড়ছে। এর সূত্র ধরে আইসডিডিআর,বি এবং রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের যৌথ উদ্যোগে ঢাকার দুটি তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে প্রযুক্তিগত সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)। সম্প্রতি মাইক্রোবায়োলজি স্পেকট্রাম জার্নালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, ক্যান্ডিডা অরিস ত্বকে আক্রমণ করে এবং প্রায়ই কোনো উপসর্গ ছাড়াই থেকে যেতে পারে। প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই আক্রমণ সংক্রমণে পরিণত হয়। বিশেষ করে রক্তের মত জীবাণুমুক্ত স্থানে প্রবেশ করলে এটি প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। এই ছত্রাক দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মৃত্যুহার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বা গুরুতর অসুস্থ রোগী এবং অপরিণত নবজাতকরা এই সংক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী। এ ছাড়া ছত্রাকটি প্রায়ই বহু ওষুধ-প্রতিরোধী, তাই ২০১৯ সালে সিডিসি একে ‘জরুরি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধী হুমকি’ হিসেবে ঘোষণা করে। এটি দীর্ঘসময় হাসপাতালের টিকে থাকতে পারে, দ্রুত ছড়ায় এবং উচ্চ মৃত্যুহার সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি

আইসিডিডিআর,বি জানায়, গবেষণায় ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি ৩৭৪ জন নবজাতককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভর্তি হওয়ার সময় ও পরবর্তী পর্যবেক্ষণ পর্যায়ে তাদের ত্বক ও রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয় ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণ বা আক্রমণের উপস্থিতি নির্ধারণের জন্য।

গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, ৩৭৪ জন নবজাতকের মধ্যে ৩২ জন (৯%) ক্যান্ডিডা অরিসে আক্রান্ত ছিলেন। এর মধ্যে ১ জন (০.৩%) রক্ত সংক্রমণে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত নবজাতকদের মধ্যে ১৪ জন (৪৪%) ভর্তি হওয়ার সময়ই সংক্রমিত ছিলেন এবং ১৮ জন (৫৬%) ভর্তি হওয়ার পরে সংক্রমিত হন। ভর্তি হওয়ার সময় সংক্রমিত ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জন অন্য কোনো হাসপাতাল বা ওয়ার্ড (যেমন প্রসূতি ওয়ার্ড) থেকে এনআইসিইউতে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন, মাত্র ১ জন সরাসরি বাড়ি থেকে ভর্তি হন। আক্রান্ত ৩২ নবজাতকের মধ্যে ৭ জন (২২%) মারা যায়, যার মধ্যে রক্ত সংক্রমিত সেই শিশুটিও ছিল।

আইসিডিডিআর,বি বলছে, এই তথ্যগুলো ইঙ্গিত দেয় যে এনআইসিইউ ও হাসপাতালের পরিবেশে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণ সক্রিয়ভাবে ছড়াচ্ছে, কারণ অধিকাংশ শিশুই ভর্তি হওয়ার পর সংক্রমিত হয়েছে। আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণায়ও দেখা গেছে, নতুন ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে কোনো কমিউনিটি-উৎসের ক্যান্ডিডা অরিস পাওয়া যায়নি, যা এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে যে সংক্রমণ মূলত হাসপাতালের ভেতরেই ঘটছে।

এ ছাড়া গবেষণায় পাওয়া ছত্রাকগুলোর নমুনার মাত্র ৩টি (৯%) বহুঔষধ-প্রতিরোধী ছিল, তবে ৮২% ফ্লুকোনাজল নামক প্রচলিত অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের প্রতি প্রতিরোধী ছিল। আশ্চর্যের বিষয়, সংক্রমিত নবজাতকদের ৮১% সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেছিল। সিজারিয়ান ডেলিভারির পর দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকার কারণে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন।

আইসিডিডিআর,বির সংক্রামক রোগ বিভাগের এএমআর গবেষণা ইউনিটের প্রধান ও সহযোগী বিজ্ঞানী ড. ফাহমিদা চৌধুরী বলেন, এই গবেষণা এনআইসিইউতে গুরুতর ও ঝুঁকিপূর্ণ নবজাতকদের মধ্যে এই সুপারবাগের সংক্রমণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দিচ্ছে। এটি প্রশাসনিক ও নীতিগত পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের একটি প্রাথমিক ও অপরিহার্য ধাপ।

গবেষকরা এনআইসিইউ ও অন্যান্য হাসপাতাল পরিবেশে ক্যান্ডিডা অরিসের বিস্তার রোধে নিয়মিত কার্যকর ক্লোরিনভিত্তিক জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের হাত ধোয়ার অভ্যাস উন্নত করার পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি এনআইসিইউতে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণের উপর ধারাবাহিক নজরদারি চালিয়ে যাওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন, যাতে সংক্রমিত বা আক্রান্ত নবজাতকদের দ্রুত শনাক্ত করে আলাদা করা যায় এবং প্রয়োজনীয় অ্যান্টিফাঙ্গাল চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা সম্ভব হয়।


সর্বশেষ সংবাদ