পবিপ্রবি
‘বঞ্চিত’ দাবি করে দুই পদোন্নতি: ‘সহযোগী অধ্যাপক’ হওয়ার ৯০ দিন না পেরোতেই হচ্ছেন ‘অধ্যাপক’!
আওয়ামী লীগ প্রশাসন আমলে নিজেকে বঞ্চিত দাবি
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০৭ PM , আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫১ AM
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) কৃষি অনুষদের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগে দীর্ঘদিন ক্লাসের বাইরে থাকা এক শিক্ষককে পরপর দুই পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে। সূত্র বলছেন, সংশ্লিষ্ট ওই শিক্ষককে প্রথমে ‘সহকারী অধ্যাপক’ থেকে ‘সহযোগী অধ্যাপক’ এবং ৩ মাসের মধ্যেই আবারও তাকে ‘অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে; যা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী ফোরাম রিজেন্ট বোর্ডের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। পদোন্নতিপ্রাপ্ত এ শিক্ষক হলেন ড. এ বি এম সাইফুল ইসলাম।
সূত্র বলছে, চলতি বছরের ২৭ জুন বাছাই বোর্ডের সুপারিশে ২৯ জুন অনুষ্ঠিত রিজেন্ট বোর্ডে এ বি এম সাইফুল ইসলামকে ‘সহযোগী অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ‘সহযোগী অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতি পেতে নিয়ম অনুযায়ী, ‘সহকারী অধ্যাপক’ হিসেবে চার বছরসহ মোট ছয় বছরের সক্রিয় শিক্ষকতার বাস্তব অভিজ্ঞতাসহ ওই পদে থাকাবস্থায় কমপক্ষে পাঁচটি গবেষণা প্রকাশনা থাকতে হয়। কিন্তু এই দুটি শর্তের একটি তিনি পূরণ করেননি। তারপরও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর দুই মাস পরেই তাকে আবার ‘অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।
৫ আগস্টের পর তৎকালীন রেজিস্ট্রার, বর্তমান উপ-উপাচার্যসহ বিএনপিপন্থি কয়েকজন প্রভাবশালী শিক্ষকের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই একটি কথিত পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে দায়মুক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছিলেন তিনি; যা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি চাকরি আইনের পরিপন্থি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে নিয়োগ পাওয়ায় এ বি এম সাইফুল ইসলাম চাকরির শৃঙ্খলাবিধি ভঙ্গের দায়ে ২০১৬ সালের ২৩ নভেম্বর (আওয়ামী লীগের আমলে) চাকরিচ্যুত হন। কোনো শিক্ষক চাকরিচ্যুত হলে মামলা করে রায়ের মাধ্যমে তা ফিরে পেতে পারেন, অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেরত দিতে পারে। কিন্তু তার চাকরি পুনর্বহালের ক্ষেত্রে এসব নিয়মের কিছুই মানতে হয়নি। চব্বিশের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তিনি তৎকালীন রেজিস্ট্রার, বর্তমান উপ-উপাচার্য প্রফেসর এসএম হেমায়েত জাহানসহ বিএনপিপন্থি কয়েকজন প্রভাবশালী শিক্ষকের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই একটি কথিত পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে দায়মুক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছিলেন; যা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি চাকরি আইনের পরিপন্থি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গঠিত এ কমিটিতে ছিলেন উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুল মালেক, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী হাসান সিকদার, রেজিস্টার অধ্যাপক ড. মোঃ ইকতিয়ার উদ্দিন এবং ডেপুটি রেজিস্টার ড. মো: আমিনুল ইসলাম। এ কমিটি যেদিন গঠিত হয়, সেদিনই তার চাকরি আশ্চর্যজনকভাবে পুনর্বহাল এবং তা ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর থেকে ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর ধরা হয়। ৮ আগেস্টে জারি করা এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত কমিটির মতামত ও রিজেন্ড বোর্ড সভার অনুমোদনের আলোকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অথচ তখনও রিজেন্ড বোর্ডের কোনো সভাই অনুষ্ঠিত হয়নি, সেই সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২১ আগস্ট।
শুধু তাই নয়, এ বি এম সাইফুল ইসলাম বকেয়া বেতনভাতা বাবদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায় ৯৫ লাখ টাকা তুলে নেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। কৃষি অনুষদের ডিনের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ভিসি ও রেজিস্ট্রারের সহযোগিতায় বকেয়া শ্রান্তি বিনোদনের সুবিধা নিয়েছেন তিনি, অথচ নিয়ম হলো ধারাবাহিকভাবে তিন (০৩) বছর চাকরি করার পরে এবং ছুটি মঞ্জুর থাকলে শ্রান্তি বিনোদন প্রাপ্য হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এ বি এম সাইফুল ইসলাম পবিপ্রবির রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো: ইকতিয়ার উদ্দিনের এলাকার লোক হওয়ার সুবাদে ক্যাম্পাসের সবকিছুতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাবের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নাম ব্যবহার করেও তার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিত করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।
এর বাইরে, গত জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা শাখার পরিচালক পদ (সাবেক পদ ছাত্র উপদেষ্টা) না পেয়ে ড. এ বি এম সাইফুল ইসলাম পরিচালকের কক্ষে তালা দিয়ে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করেন। কার্যালয়ের চাবি না থাকায় নিজের বিভাগীয় কক্ষেই শাখা পরিচালকের কার্যক্রম চালিয়ে যান নবনিযুক্ত ছাত্র নির্দেশনা শাখার পরিচালক। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
‘উপাচার্য ড. কাজী রফিকুল ইসলাম তার অনুগত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই বোর্ড দিয়ে এ বি এম সাইফুল ইসলামের অবৈধ পদোন্নতি দিয়ে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এ বি এম সাইফুল ইসলাম পবিপ্রবির ভিসি ড. কাজী রফিকুল ইসলামের খুবই ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এবং এই সম্পর্কের অন্তরালে অনৈতিক অন্য কোনো লেনদেন আছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা দরকার।’- নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক
সাইফুল ইসলামের পদোন্নতির ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক পবিপ্রবির এক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘উপাচার্য ড. কাজী রফিকুল ইসলাম তার অনুগত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই বোর্ড দিয়ে এ বি এম সাইফুল ইসলামের অবৈধ পদোন্নতি দিয়ে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। এ বি এম সাইফুল ইসলাম পবিপ্রবির ভিসি ড. কাজী রফিকুল ইসলামের খুবই ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত এবং এই সম্পর্কের অন্তরালে অনৈতিক অন্য কোনো লেনদেন আছে কিনা- তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
আরেক শিক্ষক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি ড. কাজী রফিকুল ইসলামের বিগত ১৪ মাসের এ বি এম সাইফুলের অবৈধ পদোন্নতিসহ নানাবিধ প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে পবিপ্রবির অভিভাবকের চেয়ারে বহিরাগত ভিসি নিয়োগ সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত।
অভিযোগগুলোর বিষয়ে নিজের অবস্থান ও বক্তব্য জানতে ড. এ বি এম সাইফুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ২০১৪ সালের বিগত সরকারের তৎকালীন প্রশাসন আমাকে রাজনৈতিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করে। ওই বছরই সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার কথা ছিল এবং ২০১৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এক যুগ ধরে আমি মজলুমের শিকার। আমার সহকর্মীরা এখন ২য় গ্রেডের অধ্যাপক।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পর আমি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করার পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তদন্ত কমিটি করলে অন্যায়ভাবে আমাকে চাকরিচ্যুত করার প্রমাণ পায় এবং সব ধরনের পাওনা দিয়ে দিতে বলে। আমি বর্তমানে বিগত সময়ের সব পাওনা পেয়েছি। এরমধ্যে আমি পিএইচডিও সম্পন্ন করেছি, পাশাপাশি আমার অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার জন্য যে শর্ত গবেষণা কর্মসহ সব পূরণ করেছি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলামকে অন্তত তিন দিন কল দিলেও তিনি রিসিভ করেনি। রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য ও রেজিস্টার অধ্যাপক ড. মো: ইকতিয়ার উদ্দিনকে একাধিকবার কল দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
রিজেন্ট বোর্ডের অন্য সদস্য ও কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জামাল হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের রুলস মেনেই সব করা হয়েছে। সব শর্ত মেনেই তার নিয়োগ ও পদোন্নতি হয়েছে। শর্ত পূরণ না হলে তো রিজেন্ট বোর্ড পর্যন্ত আসত না।
পবিপ্রবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি ভিসি হিসেবে থাকাবস্থায় এ বি এম সাইফুল ইসলামের প্রমোশন হয়নি। তবে চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পদোন্নতির বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস. এম. হেমায়েত জাহান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ড. সাইফুল ইসলাম চাকরিচ্যুত অবস্থায় ছিলেন বহুদিন। তার পেছনের সকল কন্টিনিউশনসহ তার চাকরিটা ফেরত দেওয়া হয়। যার ধারাবাহিকতায় চাকরিচ্যুতিকালীন সময়ের বেতন-ভাতাদিও উনি পেয়েছেন ইউজিসির অনুমোদন সাপেক্ষে। তিনি আরও বলেন, পদোন্নতির ব্যাপারে তিনি সিলেকশন বোর্ড ফেস করেছেন, এই বোর্ড তাকে সিলেক্ট করেছে এবং পরে রিজেন্ড বোর্ডও সেটির অনুমোদন দিয়েছে। তার পদোন্নতিতে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। কারণ, তার চাকরিচ্যুতির দিন থেকে তাকে ইন সার্ভিস ধরা হয়েছে। আর গবেষণা প্রকাশনা যে কয়টা প্রয়োজন ছিল, সে কয়টাই উনার ছিল।
তবে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য ও বেসিক সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ মামুন-অর-রশিদ বলেন, এরকম কোনো অসঙ্গতি থাকলে খতিয়ে দেখা হবে। রিজেন্ট বোর্ডের তো আরও সদস্য আছেন, তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন।
অনিয়মের বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য পদে থাকা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: জহিরউদ্দীনকে জিজ্ঞেস করলে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত জানালেও ‘অজানা কারণে’ এ বিষয়ে কোনোরকম মন্তব্য করতে রাজি হননি।