৬ পদের নিয়োগে কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে

  • ভাইস প্রিন্সিপাল পদের দাম ৩০ লাখ 
  • কলেজে না এসেও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষার্থী হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি অধ্যক্ষ

অধ্যক্ষ শাহেদ আলী সেখ
অধ্যক্ষ শাহেদ আলী সেখ  © টিডিসি সম্পাদিত

সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজের ফেরারি ও শোকজ পাওয়া অধ্যক্ষ মো. শাহেদ আলী সেখের বিরুদ্ধে কলেজে না এসেই হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করার প্রমাণ পেয়েছে গঠিত তদন্ত কমিটি। শুধু তাই নয়; গোপনে কলেজের ছয় পদে নিয়োগ দিতে তোড়জোড় শুরুর অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কোটি টাকা চুক্তির অভিযোগও রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. শহীদুল ইসলামসহ আরও তিন শিক্ষক গত ২৭ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগে বলা হয়, কলেজের অধ্যক্ষ মো. শাহেদ আলী সেখ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে দীর্ঘ সময় কলেজে অনুপস্থিত থাকলেও হাজিরা খাতায় নিয়মিত স্বাক্ষর করে যাচ্ছেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ১১ সেপ্টেম্বর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকার বিদায়ের পর বিধিবহির্ভূত ভাবে গঠিত কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আবদুল লতিফ সরকারের সাহায্যে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন অধ্যক্ষ শাহেদ আলী সেখ। সভাপতি আবদুল লতিফ সরকার শিক্ষক হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। তার বিরুদ্ধে বিদেশে থাকা শিক্ষকের স্বাক্ষর জাল করে বেতন উত্তোলনে সহযোগিতার অভিযোগও রয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে অভিযোগকারীরা জানান, অধ্যক্ষ মো. শাহেদ আলী সেখ একাধিক ফৌজদারি মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি হওয়ায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি গোপনে কলেজে এসে মাত্র ৫-১০ মিনিট অবস্থান করে চলে যেতেন। পরবর্তীতে জামিনে মুক্তি পেয়ে কিছুদিন নিয়মিত এলেও ১ জুলাই ২০২৫ থেকে তাকে আর কলেজে দেখা যায়নি।

‘ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজের অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া আগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য চিঠি দেওয়া হতে পারে।’—প্রফেসর বি এম আব্দুল হান্নান, মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, অধ্যক্ষ মো. শাহেদ আলী সেখ একটি ফৌজদারি মামলার এজাহারনামীয় ও ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি। জামিন বাতিল হওয়ার পর তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে সুযোগ বুঝে কলেজে এসে অল্প সময় অবস্থান করে চলে যান। ফলে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং চলতি শিক্ষা বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

এতে আরও বলা হয়, অধ্যক্ষ ও অভিযোগকারী শিক্ষকদের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্বের কারণে কলেজে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে যে কোনো সময় বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে এবং কলেজে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জরুরি হস্তক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ মো. শাহেদ আলী সেখ তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, অভিযোগকারী শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে তার বিরুদ্ধে কামারখন্দ থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। জামিন বাতিল হওয়ায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে তিনি কলেজে পূর্ণ সময় থাকতে পারছেন না, তবে ক্লাস, পরীক্ষা ও একাডেমিক কার্যক্রম সচল রাখতে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।

৬ পদে নিয়োগ দিতে কোটি টাকা চুক্তির অভিযোগ
অধ্যক্ষ মো. শাহেদ আলী সেখের বিরুদ্ধে কলেজের ছয়টি পদে নিয়োগ বাণিজ্যের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। ভাইস প্রিন্সিপালসহ ৬টি শূন্য পদে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে গোপনে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালানোর অভিযোগে এলাকাজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে প্রায় এক কোটি টাকার লেনদেন জড়িত।

সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভাইস প্রিন্সিপাল, ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট, নাইটগার্ড, পিয়ন ও আয়াসহ মোট ৬টি শূন্য পদে গোপনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পায়তারা চলছে। স্থানীয়দের দাবি, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বহুল প্রচলিত পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বিধান থাকলেও এক্ষেত্রে তাও লঙ্ঘন করা হয়েছে।

‘যিনি উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন তিনি সম্ভবত জানেন না যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগ সরকারের মাধ্যমে হবে। সেজন্য আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি না। কলেজে না এসেও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট জায়গায় পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তারাই নেবেন।’রোজিনা আক্তার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) সিরাজগঞ্জ

শুধু তাই নয়, নিয়োগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাউকে কাউকে অর্থ দিয়ে, আবার কাউকে রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে হুমকি-ধমকি দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ডিজি প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মহিতুল হাসানের ওপরও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা হযচ্ছে বলে জানা গেছে।

এদিকে গোপন নিয়োগের খবর স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন পদে নিয়োগপ্রত্যাশীরা বলছেন, বিষয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালককে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এরপরও কাউকে না জানিয়ে তরিঘরি করে অবৈধভাবে কলেজের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পায়তারা চলছে। 

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ভাইস প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগপ্রত্যাশী এক শিক্ষক বলেন, এই পদের জন্য অধ্যক্ষের শ্যালক মামুন এবং সহকারী অধ্যাপক আব্দুল আউয়ালের সঙ্গে ৩০ লাখ টাকার চুক্তি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েক লাখ টাকা অগ্রিমও গ্রহণ করা হয়েছে। এই দুইজনের মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। যদিও ভাইস প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ দেবে এনটিআরসিএ। এ সংক্রান্ত মামলা আদালতে চলমান রয়েছে।’

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ আলী সেখের ব্যবহৃত নাম্বারে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন: ৫ ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে পে স্কেল নিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত হলো

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিজি প্রতিনিধি হিসেবে মনোনিত সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মহিতুল হাসান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘গত ১১ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সজল আহমেদ একটি উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। সাতদিনের মধ্যে নিয়োগ বোর্ডে সদস্য পাঠাতে এই নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তবে ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি যখন প্রকাশিত হয়েছিল তখন দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম। নিয়োগ নিয়ে সমস্যা থাকায় আমি এখানে ডিজির প্রতিনিধি পাঠাতে পারি না।’

জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) রোজিনা আক্তার বলেন, ‘যিনি উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন তিনি সম্ভবত জানেন না যে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের নিয়োগ সরকারের মাধ্যমে হবে। সেজন্য আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোনো প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি না। কলেজে না এসেও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট জায়গায় পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তারাই নেবেন।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশি মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর বি এম আব্দুল হান্নান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ফুলজোড় ডিগ্রি কলেজের অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া আগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য চিঠি দেওয়া হতে পারে।’


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!