বিসিএসের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন, বন্ধুর কথায় শেষ চেষ্টাতেই প্রশাসন ক্যাডার
- সুজন চন্দ্র দাস
- প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১৮ PM , আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৩২ PM
টানা দুইবার বিসিএস প্রিলিমিনারিতে ব্যর্থতা, চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত, চারপাশের কটু কথা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ—সবকিছু মিলিয়ে যখন বিসিএসের স্বপ্ন প্রায় নিভে গিয়েছিল, ঠিক তখনই বন্ধুর কথায় শেষবারের মতো চেষ্টা করেন শাতিল মাহমুদ আকন্দ জয়। আর সেই শেষ চেষ্টাতেই তিনি অর্জন করেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য—৪৫তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার।
শাতিল মাহমুদ আকন্দ জয়ের বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ সদরে। শিক্ষাজীবনের শুরু প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাই স্কুলে (নার্সারি থেকে ক্লাস টু)। পরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে (ক্লাস থ্রি থেকে সিক্স) পড়াশোনা করেন। ক্লাস ফাইভে তিনি ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ফার্স্ট বয় হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
ঠিক সেই সময় এক বন্ধুর কথায় আবার মন বদলান। বন্ধু তাকে বোঝান—অন্তত একটি বিসিএস জার্নি সম্পূর্ণ করা উচিত, কারণ ভালো লিখিত দিতে পারলে ক্যাডার হওয়ার পথ অনেকটাই এগিয়ে যায়। সেই কথাতেই আবার জেদ চেপে পড়ার টেবিলে ফেরেন তিনি। আল্লাহর রহমতে লিখিত পরীক্ষায় ভালো ফল করেন।
ক্লাস সেভেনে তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলেও সামরিক জীবনের প্রতি অনীহার কারণে ক্লাস এইটের মাঝামাঝি কলেজ ত্যাগ করেন। পরে আবার প্রিমিয়ার আইডিয়াল হাই স্কুল থেকে এসএসসি সম্পন্ন করেন। এরপর আনন্দ মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন (২০১৪–২০১৮)।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে তার প্রথম লক্ষ্য ছিল বেসরকারি চাকরি এবং পরবর্তীতে দেশের বাইরে যাওয়া। সে লক্ষ্যেই তিনি প্রায় দুই বছর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রোডাকশন প্ল্যানিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় লকডাউনে বেসরকারি চাকরির অনিশ্চয়তা তাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। জিআরই (GRE)-এর প্রস্তুতির মাঝেই মায়ের পরামর্শে মাত্র দেড় মাসের হালকা প্রস্তুতি নিয়ে বিসিএস প্রিলিমিনারিতে অংশ নেন এবং উত্তীর্ণ হন।
তবে প্রস্তুতির কৌশলগত ভুলের কারণে ৪৩তম ও ৪৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এই দুটি ব্যর্থতাই তার বিসিএস যাত্রার সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়।
বিসিএসের ভালো প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বেশ কিছু চাকরি ছেড়ে দেয় এমনকি নিজের বাসার পাশেই জনতা ব্যাংক ছেড়ে দেয়। তাকে নানা কথা শুনতে হয়েছে। কেউ বলেছে—‘এতো ভালো চাকরি কেউ ছাড়ে?’, কেউ আবার বলেছে—‘মানুষ তো জব করেও বিসিএস দেয়!’ তবু তার লক্ষ্য ছিল একটাই—প্রশাসন ক্যাডার।
ভালো প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বেশ কিছু চাকরি ছেড়ে দেয় এমনকি নিজের বাসার পাশেই জনতা ব্যাংক ছেড়ে দেয়। তাকে নানা কথা শুনতে হয়েছে। কেউ বলেছে—‘এতো ভালো চাকরি কেউ ছাড়ে?’, কেউ আবার বলেছে—‘মানুষ তো জব করেও বিসিএস দেয়!’ তবু তার লক্ষ্য ছিল একটাই—প্রশাসন ক্যাডার।
টানা দুইবার ব্যর্থতার পর ৪৫তম বিসিএসকে তিনি জীবনের শেষ সুযোগ হিসেবে নেন। আগের ‘হলে হবে, না হলে নাই’ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে গ্রহণ করেন ‘ডু অর ডাই’ কৌশল।
তিনি ১০ম থেকে ৪৪তম বিসিএস পর্যন্ত সব প্রিলিমিনারি প্রশ্ন এবং নন-ক্যাডার প্রশ্নব্যাংক সম্পূর্ণ করেন, যাকে প্রস্তুতির ভিত্তি হিসেবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। প্রতিদিন নিয়মিত পড়াশোনা, লিখিত ও প্রিলিমিনারির সমন্বিত রুটিন এবং বড় মডেল টেস্টের বদলে দুর্বল বিষয়ভিত্তিক ছোট টেস্ট—এই কৌশলেই এগোতে থাকেন।
৪৫তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার মাত্র দুই মাস আগেও তার মনে হয়েছিল, এই অনিশ্চিত যাত্রায় সফলতার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন তিনি বিসিএস বাদ দিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতিও শুরু করেন। ঠিক সেই সময় এক বন্ধুর কথায় আবার মন বদলান। বন্ধু তাকে বোঝান—অন্তত একটি বিসিএস জার্নি সম্পূর্ণ করা উচিত, কারণ ভালো লিখিত দিতে পারলে ক্যাডার হওয়ার পথ অনেকটাই এগিয়ে যায়। সেই কথাতেই আবার জেদ চেপে পড়ার টেবিলে ফেরেন তিনি। আল্লাহর রহমতে লিখিত পরীক্ষায় ভালো ফল করেন।
প্রায় সাড়ে চার বছরের এই দীর্ঘ যাত্রায় তিনি বিসিএস ও নন-ক্যাডার মিলিয়ে মোট ছয়টি সরকারি চাকরিতে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অর্জন—৪৫তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার।
একসময় যিনি বিসিএসের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন, সেই তিনিই শেষ পর্যন্ত সাফল্যের দেখা পেয়েছেন দৃঢ়তা, সঠিক কৌশল এবং প্রিয়জনের সমর্থনে। শাতিল মাহমুদ আকন্দ জয়ের গল্প প্রমাণ করে—হাল ছেড়ে দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তটাই অনেক সময় সাফল্যের সবচেয়ে কাছের সময়।