ক্ষুদা, দারিদ্র, অবহেলার সাথে লড়ে শিউলি ফুটলো ডাক্তার হয়ে

শিউলি ও সমাজসেবক শামসুদ্দিন
শিউলি ও সমাজসেবক শামসুদ্দিন  © টিডিসি ফটো

সিনেমার গল্পকেও হার মানাবে শিউলির জীবনের গল্প। শৈশব-কৈশর, শিক্ষাজীবন কেটেছে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে সংগ্রামের কালিতে মাখা। ঠিকমত তিনবেলা খাবার জুটেনি পেটে কিন্তু নিজের স্বপ্নকে কখেনো মরতে দেননি। বলছি রাজশাহীর বেসরকারি বারিন্দ মেডিকেল কলেজ থেকে সদ্য পাস করা এমবিবিএস চিকিৎসক শিউলি আকতারের কথা। অভাবের কারণে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনার সময় বিয়ে হয়ে যায় তার। পড়াশুনার জন্য স্বামীর বাড়িতেও ঠাই হয়নি বেশিদিন। তবুও দমে যাননি নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে লড়াই করেছেন ক্ষুদা, দারিদ্রতা, অবহেলা আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আজ তিনি সফল। তবে এই সফলতার পুরো গল্প জুড়ে আছেন একজন সফল সমাজসেবক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন।

একজন চা দোকানির সন্তান ছিলো শিউলি আক্তার। স্বামী রাশেদুর রহমান। তাঁরা এখন রাজশাহী নগরের মেহেরচণ্ডী মধ্যপাড়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। শিউলির মা সাবিয়া বেগমও মেয়ের সঙ্গেই থাকেন। তার বাবা এখন আর নেই। অল্প দিনের জন্য মেয়ের এ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি।

আরও পড়ুন: মেডিকেল কলেজ পাচ্ছে ঝালকাঠি

এক কেজি আটার দাম তখন ১০ টাকা, আর একটা খাতার দামও ১০ টাকা। আটা কিনলে খাতা হয় না, আবার খাতা কিনলে না খেয়ে রাত কাটাতে হয়। তারপরও খাতাই কিনেছিলেন শিউলি। ভাতের অভাব থেকে মুক্তির আশায় স্কুলে পড়ার সময় মা–বাবা তাঁকে বিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বশুরবাড়িতে ভাতের অভাব ছিল না, কিন্তু সেখানেও তাঁর কান্না থামেনি। বাড়ির বউকে আর পড়াতে চাননি তাঁরা। শিউলির জেদ, তিনি পড়বেন। স্বামীও পড়াবেন। এরপর বাড়িতে শিউলির ভাত বন্ধ হয়ে যায়। না খেয়েই কলেজে যান। প্রতিবাদ করায় স্বামীসহ শিউলিকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। স্বামী সামান্য বেতনের চাকরি বাড়ি ভাড়া দিলে আর খাওয়ার কিছু থাকে না। এরই মধ্যে শিউলি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। পড়তে পড়তেই মা হয়েছেন। মা হওয়ার ১৫ দিন পর বেল্ট পরে ক্লাস করছেন।

৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছে শিউলি| সেই বৃত্তির টাকায় পড়াশোনা চালিয়েছেন। ২০১১ সালে সরদহ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় পেয়েছেন গোল্ডেন এ প্লাস। রাজশাহী কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও যাতায়াত খরচের টাকার কথা ভেবে সেখান ভর্তি হননি। ২০১৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় শিউলি আবারও সব বিষয়ে এ প্লাস পেলেন। ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল মেডিকেলে পড়বেন। প্রথমবার হলো না। দ্বিতীয়বার অল্প নম্বরের জন্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ হলো।

এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর স্থানীয় একটি পত্রিকায় খবর হয়েছিল ‘অর্থের অভাবে কি শিউলি ফুটবে না?’ এমন সময় একদিন বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামসুদ্দিন শিউলির খবর নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠালেন। সব শুনে শামসুদ্দিনই তাঁকে বারিন্দ মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিলেন। শুধু ভর্তি না, শিউলির পড়াশোনার খরচের (প্রায় ৩০ লাখ টাকা) পুরো দায়িত্ব নিলেন তিনি। পড়াশোনার বাইরেও বাসার বাজার, টুকটাক দরকারি জিনিসপত্র নিয়মিত কিনে দিয়েছেন। তার সহযোগিতাতেই শিউলি আজকে ডাক্তার হতে পেরেছেন।

নিজের শিক্ষা জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমার কলেজের অনেক ধনীর সন্তানরা আমাকে অন্যরকমভাবে দেখতো। তারা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতো এবং কটু কথা বলতো। বিশেষ করে বারিন্দ মেডিকেলে এটা বেশি হয়েছে। ক্লাসমেটরা যখন জানতে পেরেছে, আমার স্বামী ছোট কর্মচারী, ফ্রি কোটায় পড়াশোনা করি। তখন আমার পাশে কোনো ক্লাসমেট বসতো না। তারা এমনভাবে নির্যাতন করেছেন, সামনে দিয়ে হেটে গেলে, পিছন দিয়ে লাথি মারতো বা খোঁচা দিতো।

ক্যান্টিনে খেলে তারা মনে করতো, তাদের পাশে বসবো বা তাদের খাবার খেয়ে ফেলবো। তারা কোনো রেস্টুরেন্টে গেলে আমাকে কখনো আমন্ত্রণ জানাতো না। আর করার তো প্রশ্নই আসে না, কারণ আমি তাদেরকে সেখানে গিয়ে খাওয়াতে পারবো না। ২০১৯ সালের শেষের দিকে সহপাঠীরা আমাকে গ্রুপ থেকে রিমুভ দিয়ে দিলো। আমি যাতে ক্লাসে উপস্থিত হতে না পারি। ওই মেসেঞ্জার গ্রুপে জানানো হতো, স্যার বা ম্যাম কখন ক্লাস নিবেন।

আরও পড়ুন: ‘প্রথম সেমিস্টারেই প্রথম হই, তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন’

১ ফেব্রুয়ারি থেকে শিউলির ইন্টার্নশিপ শুরু হলো । ইতিমধ্যে শিউলির স্বামীও বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন। আর পুরোপুরি ডাক্তার হওয়ার পর মানুষের সেবায় নিজেকে সঁপে দেবেন। নিজে যেমন কষ্ট পেয়ে বড় হয়েছেন, সেই রকম কষ্টে থাকা মানুষের জন্য কিছু করতে চান।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে শিউলি বলেন, মাসে অন্তত একদিন আমার বাবার এলাকায় ফ্রি রোগী দেখবো। আমার মতো মেধাবী, দরিদ্র ছেলে-মেয়েরা যাতে তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, তাদের পাশে দাঁড়াবো। আর আমার স্বামীকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাবো। কেউ যাতে ছোট কর্ম বলে এড়িয়ে না যায়, বা কটু কথা বলতে না পারে।


সর্বশেষ সংবাদ