ক্লাস সিক্সে ফেল করে কান্না করা মেয়েটিই আজ গোল্ড মেডেলিস্ট
- আমান উল্যাহ আলভী
- প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:০১ PM
রানা তাবাসসুম। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে সবে পা দিয়েছিল মাধ্যমিক স্তরে, যাতে প্রথমেই বড় ধাক্কা। ক্লাস সিক্সে ফেল করে অনেক কান্না করেছিলেন। সেই তাবাসসুমই আজ গোল্ড মেডেলিস্ট। বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ১৭তম সমাবর্তনে গোল্ড মেডেল অর্জনের পর দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজের এমন খারাপ দিনের কথা জানান এ শিক্ষার্থী।
সমাবর্তনে রানা তাবাসসুম ৪-এ ৪ পেয়েছে; যা এবারের সমাবর্তনের সর্বোচ্চ ফল। নিজের অনুভূতি জানিয়ে তাবাসসুম বলেন ‘যে মেয়েটা ক্লাস সিক্সে ফ্রেঞ্চে ফেল করে অনেক কান্না করেছিল, সে-ই আজ গোল্ড মেডেলিস্ট।’ ব্যর্থতার দিনগুলো পেরিয়ে সাফল্যের শিখরে ওঠার এই রাস্তায় ছিল কঠোর পরিশ্রম, পরিবারের ত্যাগ, শিক্ষকদের সহযোগিতা আর বন্ধুদের অফুরন্ত ভালোবাসা।
তার ভাষায়, সত্যি বলতে, কখনো ভাবিনি আমি এত দূর আসতে পারব। তাই এটা আমার কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। রেসিডেনসিয়াল সেমিস্টার আমার জন্য একদম আলাদা অভিজ্ঞতা ছিল, সেই সেমিস্টারে অনেক কিছু শিখেছি। সবচেয়ে অনন্য অভিজ্ঞতা ছিল আমাদের দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করানো হতো। বন্ধুদের সঙ্গে বালতি আর ঝাড়ু নিয়ে যখন মেঝে পরিষ্কার করতে নেমেছিলাম। তখনই বুঝেছি সবাই মিলে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। আর সবাই নিজেদের কাজ ঠিকভাবে করলে শিক্ষার্থীদের যাত্রাও হয় সহজ ও সুন্দর।
ভ্যালেডিক্টোরিয়ান (সর্বোচ্চ গ্রেডপ্রাপ্ত) এ শিক্ষার্থী বলেন, এটি আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত। আমার প্রথম বছর কেটেছে কোভিড-১৯ এর মধ্যে। তখন খারাপ লাগত, কিন্তু ব্র্যাক আমাদের পাশে ছিল। অনলাইন ক্লাসে দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থী যুক্ত হত। কারও ইন্টারনেট সমস্যা, কারও বিদ্যুৎ চলে যেত। কিন্তু সব শিক্ষকই খুব সহযোগিতা করতেন। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম। আর যখন প্রথম ক্যাম্পাসে এলাম, মনে হয়েছিল ঈদ এসেছে। এতদিন পর স্ক্রিনের পেছনের মানুষগুলোর সঙ্গে সামনাসামনি দেখা সত্যিই দারুণ আনন্দের ছিল। বাবা-মাকে বলতে চাই, আশা করি আজ আমি তাদের গর্বিত করতে পেরেছি। তারা আমার জন্য যে ত্যাগ করেছেন, পরিশ্রম করেছেন, তার ফলেই আমি আজ এখানে। নীল গাউন আর মেডেল পরে আমাকে দেখে নিশ্চয়ই তারা খুশি হয়েছেন। আমি বলতে চাই যে মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ফেল করেছিল, সে-ই আজ ভ্যালেডিক্টোরিয়ান (সর্বোচ্চ গ্রেডপ্রাপ্ত)।

তিনি আরও বলেন, আমি বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটোরিয়ালে পড়েছি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে আমাদের ফ্রেঞ্চ ও চাইনিজ পড়ানো হতো। অনেক সেমিস্টার বাইরে থাকার কারণে ফ্রেঞ্চে দুর্বল ছিলাম, আর সেখানেই ফেল করি। অন্য সব বিষয়ে ভালো করলেও ফ্রেঞ্চ ভালো করতে পারিনি। পরে মাত্র তিন দিনের জন্য ক্যানবেরায় পড়াশোনা করেছি, কারণ এর বেশি নিতে পারিনি। কিন্তু সেই ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা আমাকে শক্ত করেছে। আজ আমি ভ্যালেডিক্টোরিয়ান হয়ে দাঁড়াতে পেরেছি।
বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে রানা তাবাসসুম বলেন, আমি খুবই আবেগপ্রবণ, বন্ধুরা পাশে না থাকলে আমি এতদূর আসতে পারতাম না। সহপাঠীদের প্রতিটি সহযোগিতা আমার পথচলাকে সহজ করেছে। প্রতিটি ক্লাসের পর আমরা একসঙ্গে গান গাইতাম, নাচতাম আমাদের বন্ধন ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। আমার যাত্রা আর তাদের যাত্রা পরস্পর জড়িত। ধন্যবাদ তোমাদের সবাইকে।
এবারের সমাবর্তনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মেক দ্য ডিফারেন্স’। এই প্রথম ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির এ ইনার সিটি ক্যাম্পাসে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হলো। উৎসবমুখর এবং জমকালো এবারের এ সমাবর্তনে অংশ নিয়েছেন ৩৪টি প্রোগ্রামের মোট দুই হাজার ৫৫ জন শিক্ষার্থী।
সমাবর্তনে দুইজন শিক্ষার্থীর হাতে চ্যান্সেলরের গোল্ড মেডেল এবং ২৮ জন শিক্ষার্থীর হাতে ভাইস-চ্যান্সেলরের গোল্ড মেডেল তুলে দেওয়া হয়। ১৫টি স্নাতক প্রোগ্রাম থেকে ১ হাজার ৫৯২ জন, ১৬টি স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম থেকে ৪৩৭ জন এবং ৩টি পোস্টগ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা প্রোগ্রাম থেকে ২৬ জন শিক্ষার্থী ডিগ্রি অর্জন করেন। অনুষ্ঠানে ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক এবং আমন্ত্রিত অতিথিরা অংশ নেন।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল প্রদান করেন বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের ভাইস-চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল তুলে দেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর সৈয়দ ফারহাত আনোয়ার। অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সোয়াস ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের ভাইস-চ্যান্সেলর এবং দক্ষিণ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা অ্যাডাম হাবিব।
আরও উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের চেয়ারপার্সন তামারা হাসান আবেদ এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর এম আনোয়ার হোসেন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে ভ্যালেডিক্টোরিয়ানের বক্তব্য দেন চ্যান্সেলরের গোল্ড মেডেলপ্রাপ্ত রানা তাবাসসুম।
অনুষ্ঠানের শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য দেন সমাবর্তন কমিটির চেয়ার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারপার্সন ড. সাদিয়া হামিদ কাজী।