দারিদ্র্য-দৃষ্টিহীনতা জয় করে এসএসসিতে জিপিএ-৫, স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার
- হুমায়ন কবির মিরাজ, বেনাপোল (যশোর)
- প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:৩৯ PM
দারিদ্র্য, ভাঙা ঘর আর জন্মগত দৃষ্টিহীনতা—জীবনের শুরুতে তিন দিক থেকেই অন্ধকার ঘিরে থাকলেও থেমে যাননি যশোরের শার্শার দিঘা গ্রামের কিশোরী আরিফা। এক চোখে সম্পূর্ণ অন্ধ, আরেক চোখে সামান্য আলো; তবু কেরোসিনের ক্ষীণ আলোয় রাত জেগে পড়েছেন, হাঁপাতে হাঁপাতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে গেছেন, আর নিজের মেধা ও অধ্যবসায়ের জোরে এবার এসএসসিতে অর্জন করেছেন জিপিএ–৫। প্রতিকূলতার দেয়াল ডিঙিয়ে আলোর পথে এগিয়ে চলার এই গল্প আজ অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে পুরো এলাকার মানুষের কাছে। অদম্য এই মেয়ের স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করা।
আরিফার বাবা সোহারাব হোসেন পেশায় ভ্যানচালক। প্রতিদিনের খাটুনি শেষে আয় দাঁড়ায় দুই-তিনশ টাকায়। সেই টাকায় চলে পাঁচজনের সংসার। মেয়ের পথে পথের কাঁটা সরাতে তিনি এক মুহূর্ত থেমে নেই। বলেন, ‘মেয়ে এক চোখে কিছুই দেখে না, আরেক চোখেও খুব কম দেখে। তারপরও ওর ইচ্ছা আর পরিশ্রম দেখে আমি হাল ছাড়তে পারি না। ডাক্তার হবে এই স্বপ্নেই বেঁচে আছি।’
আরিফার শৈশব ছিল কষ্টে ভরা। অভাবের কারণে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। স্কুলে যাতায়াতও ছিল বড় যুদ্ধের মতো। বাড়ি থেকে ২ কিলোমিটার দূরে চালিতাবাড়ীয়া হাইস্কুলে যেতে তাকে প্রতিদিন একাধিকবার রাস্তা পার হতে হতো। সামান্য দেখার ক্ষমতা থাকায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও ছিল বেশি। তবু নিয়মিত স্কুলে গেছেন, একদিনও পিছিয়ে পড়েনি।
এসএসসি পাস করার পর এবার আরিফা ভর্তি হয়েছে কলারোয়া সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে। বাড়ি থেকে কলেজের দূরত্ব ১৮ কিলোমিটার। প্রতিদিন যাতায়াত খরচ প্রায় ১০০ টাকা। আরিফা জানায়, অনেক দিন টাকা না থাকায় ক্লাস করতে যেতে পারে না। শুরু হয়েছে এইচএসসির ক্লাস কিন্তু বইগুলো এখনো কেনা হয়নি। সহপাঠীদের কাছ থেকে ধার নিয়ে পড়ছে সে।
আরিফার মা ফিরোজা খাতুন বলেন, ‘মেয়ের প্রতি মাসে এক হাজার টাকার ওষুধ লাগে। দারিদ্র্যের কারণে বেশির ভাগ সময়ই কিনতে পারি না। নিজের খাবারের চেয়ে মেয়ের পড়াশোনাটা চালিয়ে নেওয়াটাই আমাদের কাছে বড়।’
এ পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ যে প্রায়ই না খেয়ে দিন কাটাতে হয়। তবু মেয়ের পড়াশোনায় যেন বাধা না আসে সেই চেষ্টাই করেন বাবা-মা।
এলাকাবাসীরা বলেন, আরিফা অত্যন্ত ভদ্র ও মেধাবী। দৃষ্টি শক্তি নেই। তবু প্রতিটি পরীক্ষা দিয়েছে নিজের প্রচেষ্টায়। ইউনিট টেস্ট থেকে বোর্ড পরীক্ষা সব জায়গায়ই নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। তারা বলেন, বাবা দিন–রাত ভ্যান চালান শুধু মেয়ের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। এই পরিবারটিকে সরকারি সহায়তা পাওয়া জরুরি।
নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী আরিফা। কিন্তু পরিবারের অনিশ্চিত অর্থনৈতিক অবস্থাই তার সবচেয়ে বড় ভরসাহীনতা। চোখের কোণে পানি জমিয়ে বলে, ‘এক চোখে কিছুই দেখি না, আরেক চোখে খুব কম দেখি। তবু আমি পড়তে চাই, ডাক্তার হতে চাই। বাবা কত দিন পারবেন জানি না। সরকার আর সমাজের সহায়তা চাই আমার স্বপ্ন যেন মাঝপথে থেমে না যায়।’
শার্শা উপজেলা প্রশাসক কাজী নাজিব হাসান আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও আরিফার এমন অসাধারণ সাফল্য সত্যিই অনুকরণীয়। দারিদ্র্য ও শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে যে দৃঢ়তার সঙ্গে সে এগিয়ে যাচ্ছে, তা আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরিফার শিক্ষাজীবনে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমরা চাই এ ধরনের মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বপ্ন কোনো বাধায় থেমে না যাক।’
দৃষ্টি না থাকলেও দৃঢ় সংকল্প আর মেধা দিয়ে হাজারো বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলছেন আরিফা। সমাজ ও রাষ্ট্রের সহযোগিতা পেলে এই অদম্য কিশোরী হয়তো একদিন সত্যিই দাঁড়াবেন সাদা অ্যাপ্রোন পরে মানুষের সেবায় নিবেদিত একজন ডাক্তার হিসেবে।