বেসরকারি চাকরির অনিশ্চয়তায় সিদ্ধান্ত বদল শরীফুলের, হলেন প্রশাসন ক্যাডার

৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত শরীফুল ইসলাম
৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত শরীফুল ইসলাম  © টিডিসি ফটো

একসময় বাবার অসুস্থতায় ভেঙে পড়েছিলেন। শিক্ষা জীবন বন্ধও হতে চলেছিলো। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান শরীফুল ইসলাম। এরপর শিক্ষা জীবন শেষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ৪৩তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।

মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) বিকালে ৪৩তম বিসিএস, ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের চূড়ান্ত সুপারিশের ফল প্রকাশ করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এতে মোট ২ হাজার ৮০৫ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে জায়গা করে নেন ঢাবির এই শিক্ষার্থী।

শরীফুল ইসলামের বাড়ি ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়ায়। তার পিতা মো. হামিদুর রহমান পেশায় একজন শিক্ষক। মাতা ফজিলাতুননেসা পেশায় একজন গৃহিনী। তারা তিন ভাই ও এক বোন। তিনি তার বাবার বড় ছেলে। তার মেজো ভাই শামীমুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ বছর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। ছোট ভাই এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন দেবে। সবার বড় বোন বিবাহিত।

ঝিনাইদহ সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে এসএসসি এবং ঝিনাইদহ কে সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন শরীফুল। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা) থেকে লেদার প্রোডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন শরীফুল ইসলাম। প্রথম বিসিএসে তিনি সফল না হলেও ২য় বিসিএসে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত সফলতা। ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে তার মেরিট পজিশন ২০৫।

আরও পড়ুন: বিসিএসের নেশায় সরকারি চাকরি ছেড়েছিলেন প্রশাসন ক্যাডারে ৭ম কামরুল

বাবার অসুস্থায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়া পুরো পরিবারের সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে শরীফুল বলেন, ২০১১ সালে আমি এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু ২৮ সেপ্টেম্বর বিকালে হঠাৎ বাবা স্ট্রোক করায় পড়ালেখায় ছেদ ঘটে। দীর্ঘ দুই মাস চিকিৎসা চলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মগবাজারস্থ এসপিআরসি হাসপাতলে। কিন্তু চিকিৎসায় বাবার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তিনি প্যারালাইজড হয়ে যান। হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যায় তার। প্রস্রাব-পায়খানার ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

বাবার এমন অবস্থায় তার পরিবারের জন্য সবচেয়ে কঠিন ক্ষণটি ধারণ করে। তিন বলেন, বাবাকে আমরা সবসময় পাহাড়ের মতো শক্ত দেখে এসেছি, যিনি একা হাতে পুরো পরিবারকে আগলে রেখে এসেছেন। অথচ সেদিন আমরা প্রথম দেখলাম, কী অসহায় দৃষ্টিতে সেই মানুষটি আমাদের দিকে চেয়ে আছেন। আমরা পুরো পরিবার তখন যেন এক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

এমন পরিস্থিতিতে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই ১ম বার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাইনি। পরবর্তীতে ২য়বার পরীক্ষা দিয়ে লেদার প্রোডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ার সুযোগ হয়—জানান তিনি।

জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনের বিষয়ে তিনি বলেন, ৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারের তালিকায় নিজের রোল দেখার দিনটি সবচেয়ে আনন্দদায়ক। তবে এ ছাড়াও আরও দুটি দিনের কথা বলতে পারি- প্রথমটি হলো যেদিন আব্বার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় এবং তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে সীমিত পরিসরে হাঁটতে সক্ষম হন। আর দ্বিতীয়টি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফলাফল প্রকাশের দিন।

পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে না থাকতে বেসরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন শরীফুল। তবে তাতে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি তিনি। এক পর্যায়ে বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ২০১৭ সালে আমি রপ্তানিমুখী জুতার কারখানায় যোগদান করি। উদ্দেশ্য ছিল পরিবারের জন্য বোঝা হয়ে না থেকে বরং সহায়তা করা। কিন্তু বেসরকারি চাকরির অনিশ্চয়তা আমাকে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করে। তবে ততদিনে আড়াই বছর পার হয়ে যায়।

আরও পড়ুন: স্ত্রীর প্রথম স্বামীর শেষ বিসিএস— একসঙ্গে ক্যাডার হলেন দু’জন

তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আমার পড়াশোনা শুরু। লক্ষ্য বিসিএস। তার আগেই ৪১তম বিসিএসে আবেদন করেছিলাম। বলে রাখা ভালো, ৪১তম বিসিএসে নন-ক্যাডারে উত্তীর্ণ হলেও আমি কোনো পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হইনি। আমার পড়ালেখার বড় বৈশিষ্ট্য ছিল আমি এলোমেলো পড়াশোনা পছন্দ করি না। গুছিয়ে পরিকল্পনা করে পড়তে পছন্দ করি। অগোছালোভাবে অনেক কিছু পড়ার চেয়ে গুছিয়ে অল্প কিছু পড়লেও আমার কাছে সেটা বেশি কার্যকর মনে হয়। 

বিসিএসে দীর্ঘ যাত্রা সম্পর্কে তিনি আরও জানান, আমি প্রিলিমিনারি নিয়ে খুব বেশি গবেষণা করতাম না। প্রিলিমিনারিতে এক বিষয়ের জন্য একটা বই-ই যথেষ্ট। তবে লিখিত পরীক্ষার জন্য অনেক বই কিনেছি। একই বিষয়ের ৩-৪টি করে বই আছে আমার। প্রিলিমিনারির জন্য অনলাইনে মডেল টেস্ট দিতাম। লিখিত প্রস্তুতির বেলায় একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কিছুদিন পরীক্ষা দিলেও নিয়মিত চালিয়ে যাওয়ার মতো ধৈর্য হয়নি। আসলে লিখিত’র প্রস্তুতির জন্য পরীক্ষা খুবই কার্যকর পদ্ধতি। কিন্তু অনলাইনে লিখিত পরীক্ষা দেওয়া কঠিন। তাই সুযোগ থাকলে সশরীরে লিখিত পরীক্ষা দেওয়া উচিত।

শিক্ষার্থীদের বিসিএসে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নিয়মমাফিক পড়লেই হবে। গুছিয়ে পড়তে হবে। বিশেষ করে প্রিলিমিনারি বিশেষজ্ঞ হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। বিতর্কিত কোনো প্রশ্নের সমাধান পিএসসি দেয় না। তাই বিতর্কের জিনিস এড়িয়ে যাওয়া উচিত। প্রিলিমিনারিতে ভালো করতে হলে প্রত্যেক বিষয়ের একটি করে বই তিন-চার বার রিভিশন দিতে হবে। আর লিখিত পরীক্ষার জন্য প্রচুর লিখতে হবে। হাতের লেখা সুন্দর হওয়া জরুরি না হলেও স্পষ্ট হওয়া আবশ্যক। আর কাটাছেঁড়া যত কম হবে, ততই ভালো। গ্রাফ-চার্ট-কোটেশন তরকারির মশলার মতো। পরিমিত পরিমাণে দিলে ভালো লাগে। বেশি দিলে বাহুল্য মনে হবে।

বিসিএস জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হতেই পারে, তবে একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় উল্লেখ করে ঢাবির এই সাবেক শিক্ষার্থী বলেন, বিসিএস জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হতেই পারে তবে একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। দিন শেষে এটা একটা চাকরি। বিসিএস ক্যাডার অফিসার না হতে পারলে জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে না। তাই বিসিএসের চেষ্টা করুন। পাশাপাশি প্ল্যান বি, সি রাখুন। বেসরকারি চাকরি, উদ্যোক্তা হওয়া, রেমিট্যান্স আনয়ন ইত্যাদিও জীবিকার ভালো মাধ্যম হতে পারে। সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বিসিএসমুখী হলে শেষে সেটা ভুল সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হতে পারে। আর হ্যাঁ, আপ টু ডেট থাকুন। অনুসন্ধিৎসু হন। পত্রিকা পড়ুন। বই পড়ুন। জ্ঞানের পরিধি বাড়বে। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ জ্ঞান কাজে লাগবে।

নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি জানান, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য খুব সাদামাটা। সরকারি কর্মচারী হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করবো। যাদের ট্যাক্সের টাকায় আমার বেতন, তাদের জন্য সাধ্যমতো কাজ করে যাবো এবং পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা করে যাবো আজীবন।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence