গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কথা
পুলিশের বুলেটে মুহূর্তেই ঝাঁঝরা আকতারের দেহ, দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা আকলিমা
- মামুন হোসাইন, ভোলা প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:১৪ PM , আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৫, ০৩:৪৪ PM
২০২৪ সালের ১৯ জুলাই সকাল। জীবিকার তাগিদে প্রতিদিনের মতোই অটোরিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন আকতার হোসেন। কিন্তু কে জানত, সেটাই হবে তার জীবনের শেষ দিন? রাজধানীর ধানমন্ডিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান তিনি। মুহূর্তেই বুলেট ঝাঁঝরা করে দেয় তার শরীর। বিকেলে স্বামীকে জীবিত নয়, গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ হয়ে ফিরতে দেখেন আকলিমা বেগম। সকালে যে মানুষটি হাসিমুখে বিদায় নিয়েছিল, বিকেলে তাকে লাশ হয়ে ফিরতে দেখে ভেঙে পড়েন আকলিমা। শোকে মূর্ছা যান তিনি। কেন আমার স্বামীকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করা হলো? তার কী দোষ ছিল? বিচার চাইবো কার কাছে?—এই আর্তনাদই এখন আকলিমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পার করছে।
গত ১৫ বছর ধরে ঢাকার মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকায় ভাড়া বাসায় ছোট্ট একটি সংসার গড়ে তুলেছিলেন আকতার হোসেন। সামান্য অটোরিকশা চালিয়ে মাসে ১৫ হাজার টাকার মতো আয় করতেন তিনি। সেই সামান্য আয় দিয়েই হাসি-আনন্দে চালিয়ে নিচ্ছিলেন স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে তার স্বপ্নময় জীবন।
আকতারের শেকড় ভোলার লালমোহনের কালমা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ কালমায়। সেখানে এককালের পরিচিত হমজুউদ্দিন বাড়ির সন্তান ছিলেন তিনি। তার বাবা বজলুর রহমান ব্যাপারী হয়ত কখনো ভাবেননি, ছেলের জীবনের গল্পটা এমনভাবে থেমে যাবে।
নিহত আকতারের স্ত্রী আকলিমা বেগম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী দুইজন মিলে অনেক কষ্ট করে সংসার চালাতাম। তবে, গত ১৯ জুলাই সকালে আমার স্বামী জীবিকার তাগিদে রিকশা নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে সামনে যান। তখন আন্দোলনের কারণে এলাকা ছিল উত্তাল। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করতে থাকে।
পুলিশের করা ৪টি গুলি লেগেছিল আমার স্বামীর শরীরে। গুলি লেগে আমার স্বামীর মৃত্যু হয়। ভালো মানুষ বের হন রিকশা নিয়ে। ফিরে আসেন লাশ হয়ে। আমার স্বামী সামান্য একজন রিকশাচালক ছিলেন। তার কী দোষ ছিল, কেন তাকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, এই হত্যার বিচার চাইবো কার কাছে? তবুও বর্তমান সরকারের কাছে আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তদন্তসাপেক্ষে তাদের কঠিন শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
নিহত আকতারের স্ত্রী বলেন, আমার অসহায় স্বামীকে তো ওরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তবে এখন চরম বিপাকে পড়েছি আমার ছোট ছোট দুই সন্তানকে নিয়ে। দুই সন্তানের মধ্যে একজন ছেলে আরেকজন মেয়ে। আমি মানুষের বাসায় কাজ করি, সেখান থেকে মাস শেষে মাত্র ৫ হাজার টাকা পাই। তা দিয়ে ঢাকায় বাসা ভাড়া দিয়ে এবং খেয়ে তেমন আর টাকা থাকে না। তাই দুই সন্তানকেই আমার গ্রামের বাড়ি লালমোহনের পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের পাঙাশিয়া এলাকায় বাবা-মায়ের কাছে রেখেছি।
তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ে একটি বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে আর ছেলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। ওরা তো এখনো নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না, তবে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি ভীষণ দুশ্চিন্তায় রয়েছি। আমার এই সামান্য আয় দিয়ে কীভাবে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়বো? তাই আমার দুই সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য সরকারের কাছে আর্থিক সহযোগিতা কামনা করছি। যাতে করে ওই অর্থ ভবিষ্যতে সন্তানদের প্রয়োজনে ব্যয় করতে পারি।
আরও পড়ুন: ‘মা, তুমি ভাত খাইছো তো?’, মৃত্যুর আগে শেষবারের মত বলেছিলেন ছেলে আরিফ
অন্যদিকে, ছোট ছোট দুই নাতি-নাতনির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন দাদা মো. বজলুর রহমানও।
নিহত আকতারের পিতা বজলুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার ছেলে ঢাকায় অটোরিকশা চালিয়ে কোনোরকমে তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সংসার চালাতো। তবে আন্দোলনে আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এখন আমার দুই নাতি-নাতনিকে নিয়ে চরম অসহায় হয়ে পড়েছেন পুত্রবধূ আকলিমা।
তিনি আরও বলেন, আমি নিজে একজন দিনমজুর। তাদের যে সহযোগিতা করবো, আমারও নেই তেমন কোনো সম্পদ। তাই আমি সরকারের কাছে আমার ছেলে হত্যার সুষ্ঠু বিচার কামনার পাশাপাশি তার রেখে যাওয়া দুই সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের অনুরোধ জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহ আজিজ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, লালমোহন উপজেলায় আন্দোলনে যারা শহীদ এবং আহত হয়েছেন, তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। আমি যতটুকু জানি খুব শিগগিরই সরকারিভাবে প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে ৫ লাখ টাকা এবং আহতদের ১ লাখ টাকা করে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হবে।