অনাথ আশ্রম টু বিশ্ববিদ্যালয়
ভেতরটা কেঁদে উঠে, বঞ্চনার আক্ষেপ যেন যায় না...
- মতিউর রহমান
- প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০১৮, ১২:৫৫ PM , আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৮, ০৫:২২ PM
সুমন প্রমাণিক। যদিও নিজের নাম সুমনা শুনতেই বেশি অভ্যস্ত। বেড়ে ওঠা অনাথ আশ্রমে; বেশ সংগ্রাম করে। ছোটবেলায় পড়াশোনায় বিশেষ কারো সহযোগিতা না পেয়েও শুধু নিজের চেষ্টাই স্নাতকস্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সাল তখন ২০১৬। এরপর স্বপ্ন দেখেছিলেন স্নাতকোত্তর পড়ার। এজন্য বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায়ও গিয়েছিলেন। কিন্তু স্নাতক পরীক্ষায় গণিতে প্রাপ্ত ‘কম নম্বর’ তার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য অবশ্য ভোগান্তি কম হয়নি।
একদিকে সমাজের আড় চোখে তাকানো, অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় বাধা— উভয় সমস্যায় পিষ্ট সুমনা যখন প্রায় বিকারগ্রস্থ। ঠিক তখনই রাজ্য রূপান্তরকামী বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং কৃষ্ণনগর কলেজের রূপান্তরকামী অধ্যক্ষ মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন। শুধু এগিয়ে এলেন বললে ভুল হবে, রীতিমত কোমর বেধে লাগলেন সুমনার উচ্চশিক্ষার জন্য। তার উদ্যোগেই সুমনাকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দিতে চেষ্টা শুরু করেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
‘‘সমাজ যেখানে রূপান্তরকামীদের মানুষ ভাবতে শেখেনি, সেখানে সুমনাদের এমন লড়াই সত্যিই অনুপ্রেরণা দেয়।’’
শিক্ষামন্ত্রীর ওই চেষ্টা ব্যার্থ হয়নি; কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ও সুমনাকে খালি হাতে ফেরায়নি। অদম্য পড়ার ইচ্ছা আর প্রতিষ্ঠানের মানবিকতার জায়গা থেকেই তাকে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয়টি। জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গে এর আগে তৃতীয় লিঙ্গে কোন শিক্ষার্থীর জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। ভর্তির সময় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, ‘সুমনার মাধ্যমে তারা একজন বেশি ছাত্র ভর্তি নেওয়ার অনুমতি দিল। তাকে ‘সুপারনিউমারি’ কোটায় নেওয়া হয়েছে। ’
এরপর দু’বছর কেটে গেছে। সুমনাও তার মান রেখেছে; সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়েরও। গণিতের স্নাতকোত্তর স্তরে ৬৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে সফল হয়েছে সে। যার স্বীকৃতি হিসেবে গতকাল বৃহস্পতিবার (১নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৯তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গণিত বিভাগ থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন সুমনা। হয়েছেন বিশেষভাবে সম্মানিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠী তার হাতে মানপত্র তুলে দেন। এ সময় আবেগ-আপ্লুত সুমনা বলেন, ‘এটা বিরল সম্মান। ছোট থেকে যে সমাজ আমাকে কেবলই অসম্মান করে এসেছে, আজ সেই সমাজই আমাকে স্বীকৃতি দিল।
খুশি সুমনা। তবে আজ তার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। যখন ধরেই নিয়েছিলেন, লড়াইটা বোধহয় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কারণ মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিকের সহপাঠীরাও তার পাশে বসতে চাইত না। সুযোগ পেলেই মারধর করত লোকজন। কেউ বই-খাতা ছিঁড়ে দিত, কেউবা লুকিয়ে রাখত নোটের খাতা। তবে এক শিক্ষকের কথা আলাদা করে মনে পড়ে সুমনার। তিনি সুব্রত সরকার। সুমনার কথায়, ‘সুব্রতবাবু ছিলেন সবার থেকে আলাদা। উনি কেবল আমায় মানুষ ভাবতেন। স্যারের কাছে লিঙ্গ পরিচয় কোনও দিনই বিবেচ্য ছিল না।’ মূলত সুব্রত স্যারের সাহায্যেই সুমনা মাধ্যমিকে ভাল ফল করেন। তার পরে বিজ্ঞান নিয়ে ভর্তি হন কৃষ্ণনগরের কবি বিজয়লাল হায়ার সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউটে। পরে বগুলা কলেজ। সুমনার ভাষায় ‘ভেবেছিলাম, এবার উচ্চশিক্ষার জগতে প্রবেশ করলাম, এখানে হয়তো বিভাজন হবে না। কিন্তু বঞ্চনার অভিজ্ঞতাই ফিরে এল। বিভাগের শিক্ষকদেরও কাছ থেকেও যথাযথ সম্মান জোটেনি’।
সুমনার দাবি, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও যেন একাই থেকে গিয়েছিলেন তিনি। সকলেই যেন অস্বাভাবিক আচরণ করছিল তার সাথে। এক সময়ে তো পড়াশোনা ছাড়ার কথাও ভেবেছিলেন। কথাগুলো বলতে বলতে সুমনার ভেতরটা কেঁদে ওঠে; আক্ষেপ যেন যায় না। যাবে কীভাবে? সে যে জীবনযুদ্ধের সব স্তরে জয়ী হওয়া আলাদা এক রূপান্তরকামী।
থাক না পুরনো পৃষ্ঠাগুলো। একদিকে তৃতীয় লিঙ্গ, অন্যদিকে অনাথ আশ্রমের জীবনযুদ্ধ— দুই-ই জয় করা সুমনা যে এই মুহুর্তে ‘আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যত’ নিয়ে ভাবছেন; সেটােই তো স্বাভাবিক। অবশ্য এজন্য নিজের স্বর্বস্বটুকুও উজার করতে প্রস্তুত সে।