খুবিতে গবেষণা
জলবায়ু সংকটে বিপর্যস্ত উপকূল, খাবার কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছেন ৩০ শতাংশ মানুষ
- রাতুল খান, খুবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৪২ PM , আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ০৪:৫১ PM
জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র অভিঘাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, এই অঞ্চলের মানুষ জীবিকা, নিরাপদ পানি এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের অভাবে বিপর্যস্ত জীবনযাপন করছেন। সংকট এতটাই তীব্র যে, মানুষজন তাদের মূল ভিটেমাটি ছেড়ে শহরের বস্তি এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন, যা একটি নতুন মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে এডুকো ও উত্তরণের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে পরিচালিত গবেষণাটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী। গবেষণার জন্য সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি ইউনিয়ন বুড়িগোয়ালিনী, গাবুরা ও পদ্মপুকুর এবং জলবায়ুতাড়িত বাস্তুচ্যুত মানুষে পূর্ণ সাতক্ষীরা পৌরসভার পাঁচটি বস্তি এলাকাকে বেছে নেওয়া হয়।
প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ তাদের দৈনন্দিন খাবার কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে ভাত ও ডালের বাইরে অন্য কোনো খাবার জোগাড় করতে পারছেন না। কর্মসংস্থানের অভাবে এই অঞ্চলের পুরুষদের একটি বড় অংশ বছরে ৬ থেকে ৮ মাসের জন্য পরিবার ছেড়ে ইটভাটা বা অন্য শহরে কাজে পাড়ি জমান। এর ফলে এলাকায় নারী-প্রধান পরিবারের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপকূলের চিত্র: জীবিকার খোঁজে মরিয়া মানুষ
গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলীয় ইউনিয়নগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। সিডর ও আইলার মতো ঘূর্ণিঝড় এই অঞ্চলের চিংড়ি ও ধানের খামার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। জীবিকার সন্ধানে মানুষ নেতিবাচক অভিযোজন কৌশল বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ তাদের দৈনন্দিন খাবার কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে ভাত ও ডালের বাইরে অন্য কোনো খাবার জোগাড় করতে পারছেন না। কর্মসংস্থানের অভাবে এই অঞ্চলের পুরুষদের একটি বড় অংশ বছরে ৬ থেকে ৮ মাসের জন্য পরিবার ছেড়ে ইটভাটা বা অন্য শহরে কাজে পাড়ি জমান। এর ফলে এলাকায় নারী-প্রধান পরিবারের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ১৭৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় 'মেলিসায়' বিপর্যস্ত জ্যামাইকা
পানি ও স্যানিটেশন: নীরব স্বাস্থ্য বিপর্যয়
গবেষণায় সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনায়। তিনটি ইউনিয়নেই নিরাপদ পানীয় জল এবং গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার্য জলের তীব্র সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের অভাবে নারী ও মেয়েরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, এই এলাকার নারীদের মধ্যে জরায়ু সংক্রান্ত সমস্যা (৬০-৭৪%) এবং প্রজননগত সমস্যা (৪৫-৬৬%) উদ্বেগজনক হারে দেখা গেছে। এর পাশাপাশি, নদীর দুর্বল বা অনুপযুক্ত বাঁধগুলো এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
গন্তব্য বস্তি: সংকটের নতুন রূপ
উপকূল থেকে বাস্তুচ্যুত এই মানুষেরা আশ্রয় নিচ্ছেন সাতক্ষীরা পৌরসভার বস্তিগুলোতে। কিন্তু সেখানেও মিলছে না স্বস্তি। গবেষণায় উঠে এসেছে, এই বস্তি এলাকাগুলো সংকটের এক নতুন রূপ ধারণ করেছে। স্বল্প আয়ের (যেমন রিকশা চালানো বা দিনমজুরি) কারণে বস্তিবাসীরা তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন। অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়, যা তাদের জীবনযাত্রাকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অপর্যাপ্ত টয়লেট, অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন সুবিধা এবং নিরাপদ পানীয় জলের তীব্র সংকট। এই সম্মিলিত দারিদ্র্য শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে; তারা স্কুল থেকে ঝরে পড়ে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে, যা দারিদ্র্যের এই চক্রকে স্থায়ী রূপ দিচ্ছে। তদুপরি, অনেক বস্তিবাসী সরকারি খাস জমিতে বাস করায় ক্রমাগত উচ্ছেদের আতঙ্কেও থাকেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলের মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছেন, কিন্তু উভয় স্থানেই তারা বিপর্যস্ত। উপকূলে লবণাক্ততা ও কর্মসংস্থানের অভাব, আর বস্তিতে দারিদ্র্য ও জলাবদ্ধতার সংকট। - অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী, পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষকের সুপারিশ: যা করা জরুরি
গবেষক অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী এই দ্বিমুখী সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা প্রদান করেছেন। এর একাংশ উপকূলীয় ইউনিয়ন এবং অপরাংশ শহরের বস্তিগুলোর জন্য। উপকূলীয় ইউনিয়নের জন্য সুপারিশগুলো হল- ১. কৃষি ও জীবিকা: লবণাক্ততা-সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি ও বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা। পাশাপাশি জলবায়ু-সহনশীল স্থানীয় জাতের গবাদি পশু পালনে উৎসাহিত করা। ২. স্বাস্থ্য ও পানি: জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের জন্য, এবং নিরাপদ পানির সুবিধা নিশ্চিত করা। ৩. প্রকল্প: সুপারিশের ভিত্তিতে পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করা।
শহরের বস্তিগুলোর জন্য সুপারিশগুলো হল- ১. দারিদ্র্য নিরসন: বস্তিবাসীর দারিদ্র্য কমাতে সরাসরি নগদ অর্থ সহায়তার পরিবর্তে, তাদের বিদ্যমান জীবিকা টেকসই করতে ‘শুধুমাত্র উপকরণ সহায়তা’ প্রদান করা। ২. শিশুশ্রম রোধ: শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে শিশুদের জন্য ‘শিক্ষা সহায়তা’ (যেমন টিউশন ফি, পোশাক, টিফিন ইত্যাদি) নিশ্চিত করা। ৩. অবকাঠামো: জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নিরাপদ পানি ও টয়লেট সুবিধা বৃদ্ধি করা।
গবেষক অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরীর বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলের মানুষ ভিটেমাটি হারিয়ে শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছেন, কিন্তু উভয় স্থানেই তারা বিপর্যস্ত। উপকূলে লবণাক্ততা ও কর্মসংস্থানের অভাব, আর বস্তিতে দারিদ্র্য ও জলাবদ্ধতার সংকট। আমাদের সুপারিশ হলো উপকূলে লবণাক্ততা সহনশীল কৃষি চালু করা এবং বস্তিতে দারিদ্র্য কমাতে নগদ টাকার বদলে ‘উপকরণ সহায়তা’ ও শিশুশ্রম বন্ধে ‘শিক্ষা সহায়তা’ নিশ্চিত করা। উভয় ক্ষেত্রেই, স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা ছাড়া টেকসই সমাধান সম্ভব নয়।