জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জরাজীর্ণ ছাত্রাবাসে শিক্ষার্থীদের বসবাস, হেরিটেজ তকমায় নিশ্চুপ প্রশাসন

জরাজীর্ণ মঙ্গলাবাস
জরাজীর্ণ মঙ্গলাবাস  © টিডিসি

প্রাচীন আমলে নির্মিত পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের মোহিনী মোহন দাস লেনে অবস্থিত জরাজীর্ণ মঙ্গলাবাস প্রাসাদটি কবি নজরুল সরকারি কলেজের একমাত্র ছাত্রাবাস হিসেবে প্রায় পাঁচ দশক ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলা ও নানা সংকটে জর্জরিত। দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য বহনকারী মূল্যবান মঙ্গলাবাস প্রাসাদে মূল্যহীন অবস্থায় জীবনযাপন করছে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। অসংখ্য দাবি, অভিযোগ ও আকুতির পরেও মঙ্গলাবাসে নজর নেই প্রশাসনের।

সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে একাধিকবার জানানো সত্ত্বেও তারা উদাসীন । হেরিটেজ তকমা ও সরকারি বরাদ্দ না থাকায় স্থায়ী সমাধান মিলছে না বলেই ক্ষান্ত কলেজ প্রশাসন। ভোগান্তি দূর করতে পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবার স্থায়ী সমাধান কোথায় মিলবে জানতে চাই শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী এই প্রাসাদটির মালিক ছিলেন জমিদার যতীন্দ্র কুমার সাহা। তিনি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় তার এই সম্পত্তি ফেলে কলকাতায় চলে যান। এরপর মুক্তিযুদ্ধের কিছু পূর্বে থেকে ঐতিহ্যবাহী এই প্রাসাদটি কবি নজরুল সরকারি কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ এই কলেজের শিক্ষার্থী শামসুল আলমের নামেই ভবনটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাস।

প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই প্রাসাদে নানান প্রতিকূলতা ও দুরবস্থার মধ্যেই শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করছে প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মানহীন খাবার, বিশুদ্ধ পানির সংকট ও অপ্রতুল আবাসন-ব্যবস্থার কারণে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক দুর্দশা দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। জানা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে ছাত্রাবাসে অসুস্থ হয়েছে প্রায় ত্রিশ শিক্ষার্থী।

পাঁচ দশক পেরিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে এসেও ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীরা এখনো কুয়ার পানির উপর নির্ভরশীল। নিয়মিত পানি না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে নানান ভোগান্তিতে। পানির লাইনে প্রায়ই সমস্যা দেখা দেয় কখনও কয়েক ঘণ্টা, আবার কখনও একদিনের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকে পানি। এতে গোসল, হাতমুখ ধোয়া কিংবা প্রাকৃতিক প্রয়োজন মেটাতেও চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় শিক্ষার্থীদের।

এছাড়া, মাত্র একটি ফিল্টারের মাধ্যমে শতাধিক শিক্ষার্থীর বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণ করাও হয়ে উঠেছে কঠিন। এই ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে শিক্ষার্থীরা নিজ উদ্যোগে বিশ কিংবা পঞ্চাশ টাকা করে চাঁদা তুলে সমাধান করার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে বহুবার।

বর্ষা এলেই মঙ্গলাবাসে বাড়ে দুর্ভোগ, প্রায় প্রতিটি কক্ষেই ছাদ চুঁইয়ে চুইয়ে পড়ে বৃষ্টির পানি। নগরবাসীর কাছে বর্ষা যতটা স্বস্তির ঠিক তার উল্টোই বৃষ্টি নামলেই যেন মঙ্গলাবাসে অস্বস্তির বন্যা বয়ে যায়। বৃষ্টি এলেই ছাত্রাবাসে শুরু হয় শিক্ষার্থীদের নির্ঘুম যুদ্ধ। রাতভর বালতি, মগ আর হাড়ি ভরে সরাতে হয় ছাদ চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির পানি। অনেক শিক্ষার্থীর বইপত্র ও বিছানাও ভিজেছে বৃষ্টির পানিতে। 

দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় প্রতিটি কক্ষেই বেহাল দশা, দেয়ালের পলেস্তারা খসে বেরিয়ে এসেছে ইট। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি পড়ে পলেস্তারা নরম হয়ে যায় , ফলে যেকোনো সময় পলেস্তারা খসে পড়ার শঙ্কা থাকে। তাই দুর্ঘটনা এড়াতে অনেকেই বিছানার উপর তৈরি করেছে প্লাস্টিকের পর্দা।

এই জীর্ণ ছাত্রাবাসের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র চারটি শৌচাগার ,যা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। এই   শৌচাগারগুলোর অবস্থাও এতটাই নাজুক যে, সেগুলো একেবারেই ব্যবহার যোগ্য নয়। 

ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা ও আবর্জনার স্তূপ,এতে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে । প্রাচীন এই ছাত্রাবাসে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত কোন ক্যান্টিন নেই। খাবারের জন্য একটি ডাইনিং ব্যবস্থা রয়েছে, তবে সেখানে স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবারের অভাব প্রকট। একটি ডাইনিং থাকলেও সেখানে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে খাবার রান্না হয় দাবি শিক্ষার্থীদের।

শতবর্ষী প্রাচীন এই প্রাসাদের সামনেই ‘মুক্তি খেলাঘর আসর’ নামে একটি ক্লাব রয়েছে। দিনভর ক্লাবের সামনে শিশু-কিশোররা বিভিন্ন খেলাধুলায় মেতে থাকে, এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে চলে আড্ডা। উচ্চস্বরে শব্দ করায় পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে  ছাত্রাবাসের শিক্ষার্থীদের।

এছাড়া ছাত্রাবাসে আসনের সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থীকে কক্ষ ভাগাভাগি করে কিংবা মেঝেতে ঘুমাতে হয়। ফলে অনেক কক্ষেই পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ নেই। এক কক্ষে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী থাকার ফলে রোগ জীবাণুর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, যার কারণে শিক্ষার্থীরা ঘন ঘন নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

এসব সমস্যা থেকে রেহাই পেতে সাত দফা দাবিতে ১৯ মে আন্দোলনে নেমেছিলেন কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা ঘেরাও করেছিল ডিসি অফিস। সেদিন ডিসি অফিস থেকে শিক্ষার্থীদের অধিগ্রহণের কথা জানানো হলে, পরবর্তীতে কলেজ প্রশাসন মঙ্গলাবাস ভবনটি কবি নজরুল সরকারি কলেজের নামে বরাদ্দের জন্য আবেদন করেন। তবে কয়েক মাস কেটে গেলেও অধিগ্রহণের কার্যক্রম এখনও সেই আবেদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

ছাত্রাবাসে অবস্থানরত মনিরুজ্জামান মারুফ নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, এই হলে আমাদের প্রতিদিন বেঁচে থাকাই একটা চ্যালেঞ্জ। খাবারের মান অত্যন্ত খারাপ, নোংরা পরিবেশ, পানি থাকেনা, নিরাপত্তা নেই তবুও উপায় না থাকায় থাকতে হচ্ছে। 

তিনি আক্ষেপ করে আরও বলেন, এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমরা বহুবার কলেজ প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি, কিন্তু কোনো সমাধান পাইনি। প্রতিবারই হেরিটেজ আর সরকারি বরাদ্দ নেই শুনেই আসতে হয়েছে। তাহলে কোথায় মিলবে এর স্থায়ী সমাধান? দেড় শতাধিক জীবনের মূল্য কি হেরিটেজের কাছে কিছুই না ? 

মুন্না নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, এই ছাত্রাবাসে থাকলে আপনি মানসিকভাবে শক্তিশালী হবেন ঠিকই, তবে সেটা শিক্ষাজীবনের অংশ হিসেবে নয়, বরং টিকে থাকার লড়াইয়ের জন্য।

তিনি বলেন, শহীদ শামসুল আলম ছাত্রাবাস নামেই শুধু একটি ছাত্রাবাস। শতাব্দীর সবচেয়ে অবহেলিত বোধহয় এই হলের শিক্ষার্থীরাই । এখানে আমাদের নির্দিষ্ট কোন অভিভাবক পর্যন্ত নেই । কিছুদিন আগে শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে ছাত্রাবাসের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে সেই কমিটির কার্যক্রম কেন বন্ধ হয়ে গেল? আমরা স্থায়ী অভিভাবক চাই যিনি কিনা হলের সমস্যা গুলো নিয়ে কাজ করবে এবং সমাধানের পথ দেখিয়ে দিবে।

কবি নজরুল কলেজের ছাত্রাবাস অধিগ্রহণ পূর্বক কলেজের নামে বরাদ্দের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, এই মাসের ২৫ তারিখ শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কেন বরাদ্দ আসে না জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, মঙ্গলাবাস ভবনটি আমাদের নামে নয়। ভবনটি আমাদের নামে হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দিয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করে আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করবে। তবে খাওয়া-দাওয়া ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা নিজেদের করতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর আহমেদ জানান, অধিগ্রহণের প্রস্তাব কলেজ প্রশাসন আমাদের দিবেনা বলেছেন। কারণ অধিগ্রহণের জন্য যে শর্তগুলো পূরণ করতে হয়, সেগুলো তাদের জন্য কঠিন হবে। এ কারণে কলেজ প্রশাসন লিজের আবেদন করেছে।

তিনি আরও জানান, এখন যারা সেখানে লিজ নিয়ে আছে, তাদের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। প্রথমে তাদের লিজ বাতিল করতে হবে, এরপর কলেজকে লিজ দেওয়া যাবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারবেন অর্পিত সম্পত্তির ম্যাজিস্ট্রেট সোনিয়া হোসেন জিসানের কাছ থেকে।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence